স্বৈরাচারী শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধে সংবিধান সংশোধন দরকার : ড. কামাল হোসেন
নভেম্বর ২, ২০২৪

ভবিষ্যতে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি রোধে সংবিধান সংশোধন করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন। তিনি সাম্প্রতিক ছাত্র-ছাত্রী এবং জনতার সফল আন্দোলনের সংবিধানকে নতুন পর্যালোচনা করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।  

তিনি বলেন, '১৯৭১ এ আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত অধিকার নিয়ে সংবিধান রচনা করেছিলাম যেখানে  বৈষম্য নিরসন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। এবারের আন্দোলনে আবারও বৈষম্য নিরসনের বিষয়টি সামনে এসেছে। একইসাথে  স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার কোনো সুযোগ যাতে না থাকে, সে আলোকে সংবিধানের সংশোধনীর সুপারিশ তৈরি করতে হবে।'

বক্তব্যে কামাল হোসেন আরও বলেন, ' গত জুলাই আগস্ট মাসে আমরা যে ভয়াবহ এবং কষ্টদায়ক ঘটনাবলি দেখেছি, তা আমাদের অন্তরাত্মাকে নাড়া দিয়েছে। আমাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং অজস্র নাগরিকে উপর ঘটে যাওয়া গণহত্যা ও দমন-পীড়ন, এবং আইনের শাসনের প্রতি যে অবজ্ঞা আমরা দেখেছি, তা অবশ্যই আমাদের সংবিধানে স্থান পাওয়া উচিত। আমরা যেন এই শিক্ষাগুলোকে আমাদের সংবিধানের মূল কাঠামোতে গেঁথে দিতে পারি, যাতে কোনো নাগরিকের সাথে অন্যায়, অবিচার আবার না ঘটে। এটাই হবে আমাদের সংবিধানের সত্যিকারের পরীক্ষা।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে, দেশের মানুষের আকাঙক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে, একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়সঙ্গত , এবং সাম্যভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে লিঙ্গ, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, রাজনৈতিক বা অন্যান্য মতভেদ এবং প্রতিবন্ধীতা বা জাতিসত্তার কারণে কারো বিরুদ্ধে কোনো ধরনের বৈষম্য করা হবে না। আগামীতে আমাদের এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সংবিধান নিয়ে এবং সময় উপযোগী সংস্কার এর বিষয় নিয়ে কাজ করতে হবে।’

০২ নভেম্বর ২০২৪ শনিবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরসি মজুমদার মিলনায়তনে আয়োজিত 'গণঅভ্যুত্থান ও রাষ্ট্র সংস্কার: সংবিধান বিষয়ে কর্তব্য ও গন্তব্য’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও আইনের কথা।  

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংবিধান গবেষক আরিফ খান। অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চিন্তাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক  ডা. জাহেদ উর রহমান, এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট  মুস্তাফিজুর রহমান খান।

মূল প্রবন্ধে সংবিধান গবেষক আরিফ খান বলেন, ‘জুলাই মাসে সংগঠিত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ছিল রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক মহা-জাগরণ। এই জাগরণ আমাদের অতীত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার আলোকে গুরুতর ও আত্মঘাতী সব ভুলত্রুটির সংশোধন করে নিজেদেরকে পুনর্নিমার্ণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সামনে এনে দিয়েছে। তাই জুলাই মহা-জাগরণ আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বসাম্প্রতিক রেনেসাঁ।’

আরিফ খান তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘আমি এই জাতিরাষ্ট্রের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে উত্থিত, লালিত ও গৃহীত সাংবিধানিক আদর্শসমূহের ধারাবাহিকতার পক্ষে। তাই আমি সংবিধান সংস্কারেরও পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সাংবিধানিক কাঠমো ও আদর্শসমূহকে সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়নের চেষ্টা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সাংঘর্ষিক মতাদর্শসমূহকে লড়াকু অবস্থায় ঠেলে দিবে। ফলে তা জাতীয় জীবনে এক বিশাল শূন্যতা ও বিরোধের সৃষ্টি করবে। তাই আমাদের বর্তমান কর্তব্য নির্ণয়ের প্রয়োজনে সংবিধান ছুড়ে ফেলা নয় বরং প্রয়োজন সাংবিধানিক রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণের। আমরা যেন ভুলে না যাই, এই জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মুক্তির অভিপ্রায়ে যেসব রাষ্ট্রীয় আদর্শ আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রহণ করেছিলাম সেগুলোর ক্রমাগত অবমাননা, বিকৃতি, বিনাশ ও ধ্বংস সাধনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী গত পাঁচ দশকের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, সংবিধান নিজেই ফ্যাসিবাদের বিধ্বংসী ছোবলে রক্তাক্ত হয়েছে, খোদ সংবিধান কখনো ফ্যাসিবাদকে প্রশ্রয় দেয়নি।'

ডা. জাহেদ উর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, 'আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ কারণেই অভ্যুত্থান হয়েছে। তাই  গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার।’

অ্যাডভোকেট মু্স্তাফিজুর রহমান খান নির্বাচিত সরকারের হাতে সংবিধান সংশোধনের দায়িত্ব দেয়ার পক্ষে মত প্রদান করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা শিক্ষার্থীদের বেকারত্ব হ্রাস করতে ব্যক্তি খাতের বিকাশে সরকারকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন।  

অনুষ্ঠানটিতে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী মো. জুলফিকার ইসলাম। অনুষ্ঠানে রিডিং অ্যাসোসিয়েটবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং নানা শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

cross-circle