হিল্লা বিবাহ:বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন ও সমাজ বাস্তবতা।
এপ্রিল ১০, ২০২২

রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ৪৫০তম সাপ্তাহিক লেকচার
বক্তা: নুসরাত জাহান রোদন

বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থার সাধারণ দিক হচ্ছে, দেশের প্রচলিত আইনের সাথে সামাজিক রীতিনীতির ব্যাপক তফাৎ। আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মাধ্যে পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে। তাছাড়া আইন  উপর মানুষের অবিশ্বাস বিদ্যমান। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে যখন রাষ্ট্রীয় আইনের বিরোধ হয়, তখন সমাজ শক্তিশালী চলক হিসেবে কাজ করে। ফলে পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইন অকার্যকররূপে আবির্ভূত হয়। বিবাহ সংক্রান্ত ব্যাপারে এই বিষয়টি প্রকট।    

হিল্লা বিবাহ এমন একটি সামাজিক প্রথা যেখানে নারীর অধিকার এবং মর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুন্ন করা হয়। এই আলোচনায় হিল্লা বিবাহ সম্পর্কে প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও দেশে প্রচলিত আইনের মধ্যকার বিরোধ এবং এর কারনগুলো ব্যাখা করা হয়েছে। হিল্লা বিবাহকে উর্দুতে নিকাহ বা হালালা বলা হয়ে থাকে। এটি একটি সমাজিক প্রথা যেখানে একজন মহিলা মুখে মুখে তিন তালাকের মাধ্যমে তালাকপ্রাপ্ত হন। তার স্বামী যদি তাকে আবার ফিরিয়ে নিতে চান তাহলে তাকে অন্য এক পুরুষের সাথে একদিন বা নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তি সাপেক্ষে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে হয়। এরপর নতুন স্বামীকে তালাক দিয়ে পূর্বের স্বামীকে বিয়ে করতে হয়। এই বিয়েকেই হিল্লা বিয়ে বলা হয়। পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারায় বিবাহ এবং বিবাহ বিচ্ছেদ পরবর্তী বিবাহ নিয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে যদি স্বামী একত্রে বসবাস করতে না চায় তাহলে তারা বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে। তবে যদি পুনরায় স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে চান তাহলে স্বাক্ষী এবং পুনরায় দেনমোহর সাপেক্ষে বিবাহ করতে পারেন।  

হিল্লা বিবাহ  কীভাবে আসল-

প্রাক ইসলামিক যুগে স্বামীদের তালাক দেওয়ার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। তারা তাদের ইচ্ছানুযায়ী স্ত্রীদের তালাক দিতো। আবার তাদের ফিরিয়ে এনে নির্যাতন করত এবং ইচ্ছা হলে আবার তালাক দিত। ইসলামের আবির্ভাবের পর এই অত্যাচার বন্ধে হিল্লা বিবাহের উৎপত্তি হয়। কিন্তু নবম শতাব্দীতে আরবের উমাইয়া বংশের শাসনামলে তাৎক্ষণিক মৌখিক তালাকের ব্যাপক চর্চা হতে থাকে। স্ত্রীকে আবার ফিরিয়ে আনার জন্য হিল্লা বিয়ে করে। এটা পরবর্তীতে সমাজে স্বীকৃতি পেয়ে যায়। পরে তা অন্যান্য মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় ছড়িয়ে পরে। বর্তমানে পাকিস্তান এবং ভারতে হিল্লা বিবাহ একটি উদ্বেগের বিষয়। বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১ অনুযায়ী মুখে মুখে তালাক দিলে তা কার্যকর হবে না। অর্থাৎ মুখে তালাক বললেই তালাক হবে না। 

পাকিস্তান আমলে হিল্লা বিবাহের প্রচলন ছিল। স্বাধীনতার পরেও আমাদের সমাজে এ প্রথা চালু থাকে। ১৯৯০ এর দশকে হিল্লা বিবাহ একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। বেশ কয়েকটি ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। উত্তরবঙ্গের জমিরুনের ঘটনা তার মধ্যে একটি। সাধারণত উত্তরবঙ্গে হিল্লা বিবাহের প্রচলনটা বেশি দেখা যায়। ২০০৭ সালে এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে এক গ্রামে এক বছরে ১৬টি হিল্লা বিবাহ হয়েছিল। সেখানকার এক এনজিওর নির্বাহী পরিচালক জানান, এ গ্রামে প্রায় দুই দশক ধরে হিল্লা  বিবাহ হচ্ছে এবং সেখানে হিল্লা বরও রয়েছে।তারা টাকার বিনিময়ে তালাকপ্রাপ্ত নারীদের বিয়ে করে এবং এক বা দুদিন পর তাদের আবার বিচ্ছেদ হয় এবং সেসকল নারীগণ পুনরায় তাদের পূর্বের স্বামীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে।  

মৌলভীবাজারের নুরজাহানের ঘটনা ছিল সবচেয়ে বেশি অবাক করা। পরবর্তীতে ২০০১ সালের আরেকটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টে একটি রিট হয়, সেখানে হিল্লা বিবাহ সম্পর্কিত সকল ধরনের ফতোয়াকে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়। একটি আইন জরিপে ৫০ জন ব্যক্তির মতামত নেওয়া হয়েছিল। সেখানে দেখা গেছে তাদের মতামত ধর্মীয় আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এবং মতামতের ভিন্নতা দেখা গেছে। হিল্লা বিবাহ নিয়ে আইন এবং সমাজের বিপরীত গতিমুখের অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী হিল্লা বিবাহ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

আইন অনুসারে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও হিল্লা বিবাহ সমাজে প্রচলিত আছে কেন?  এর কিছু কারণ থাকতে পারে, যেমন-দারিদ্র্যতা ও শিক্ষার হার ইত্যাদি। ২০০১ সালের রায়ের আগে এবং পরে উত্তরবঙ্গে হিল্লা বিবাহ চালু ছিল । সেখানে শিক্ষার হার তুলনামূলক কম। তাছাড়া ২০১৬ সালের এক জরিপ অনুযায়ী দেখা যায় রাজশাহী এবং রংপুর জেলায় যথাক্রমে ২৮.৯৩% ও ৪৭.২৩% শতাংশ মানুষ দরিদ্র সীমার (Proportion of population below upper poverty line) নিচে বসবাস করে। এর থেকে বলা যায় যেহেতু উত্তরবঙ্গে শিক্ষার হার কম এবং দারিদ্রের হার বেশি, তাই সেখানে ফতোয়া প্রদান বা গ্রহণের প্রবণতা বেশি। তাছাড়া গ্রামের ক্ষমতা সম্পর্কিত কাঠামোও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। নুরজাহানের ঘটনায় এ বিষয়টি দেখা গেছে। সেখানে এক মৌলানা নুরজাহানের দ্বিতীয় বিবাহকে হিল্লা বিবাহ বলে তাদের বিবাহকে নিষিদ্ধ বলে ফতোয়া জারি করেন তারা সেটা মেনে না নিলে তাদের উপর অত্যাচার করে। সেখানে এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিরও ভূমিকা ছিল। 

বাংলাদেশে সাধারণত আর্থ-সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা নারীরাই হিল্লা বিবাহের শিকার হয়ে থাকে। প্রান্তিক ও দরিদ্র নারীরাই এর প্রধান বলি। এসব কাজে ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রান্তিক পর্যায়ের নারীদের উপর অত্যাচার করার হাতিয়ার হিসেবে হিল্লা বিবাহকে বেছে নেওয়া হয়েছে।   

উন্মুক্ত আলোচনা

জাকিয়া আফরিন বলেন, ইসলাম একটি ধর্ম, সংস্কৃতি নয়। বিভিন্ন  সংস্কৃতির মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পরও এই ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে তাদের পুরোনো সংস্কৃতি রয়ে গেছে, সেটা ভালো হোক কিংবা খারাপ। কিন্তু এর সাথে ইসলামের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। উত্তর আফ্রিকায় অনার কিলিং বলে একটি প্রথা দেখা যায়। পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে মেয়েকে গুম বা খুন করে ফেলা। এটার সাথে ইসলামে কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তারা ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার পরেও তাদের মধ্যে এটা রয়ে গেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে হিল্লা বিবাহ একটা সমস্যা। এগুলো প্রতিরোধে আইনের প্রণয়নের পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। আইন বিশেষজ্ঞেদের পাশাপাশি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রয়োজন রয়েছে।

নাজমুল ইসলাম বলেছেন, আইন অনুসারে হিল্লা বিবাহ বৈধ নয়। তবে সাধারণ মানুষ আইন সম্পর্কে পর্যাপ্ত ধারণা রাখে না। হিল্লা বিবাহের শিকার ব্যক্তি আইন সম্পর্কে জানলে আদালতে  প্রতিকার চাইতে পারতো। এই অজ্ঞতার কারণে সে সমাজের বাধ্যবাধকতা মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।  

ইয়াসিন ইলাহি বলেন, হিল্লা বিবাহ নারীকে বারবার হেনস্তা করার একটা অস্ত্র যা প্রাক ইসলামিক যুগেও ছিল। মসজিদ মাদ্রাসার ইমামগণ তাদের উপার্জনের জন্য সমাজপতিদের উপর নির্ভরশীল থাকে। ফলে তাদের ফতোয়া অনেক সময় এই সমাজপতিদের মতামত দ্বারা প্রভাবিত হয়।      

cross-circle