ভ্যান শেন্ডেলের বাংলাদেশ
জুন ২৬, ২০১৭

২৭৬ তম সাপ্তাহিক পাবলিক লেকচার

বিষয়: ভ্যান শেন্ডেলের বাংলাদেশ

বক্তা: আতাউর রহমান মারুফ

তারিখ: ১৮ আগস্ট, ২০১৭

১৯৭৪ সালের শেষের দিকে ভেলাম ভ্যান শেন্ডেল বাংলাদেশে আসেন। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ আক্রোশে অনাহারে মারা যাচ্ছে লাখো মানুষ। এই দুর্ভিক্ষ চট্টগ্রামের অধ্যাপক ড. ইউনূসের চিন্তাজগত পাল্টে দিয়েছে। অর্থনীতির তত্ত্ব ছেড়ে তিনি মাঠে নেমে পড়েছিলেন। সিলেটে, রংপুরে আবেদ ব্র্যাক নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। রংপুরে গড়ে উঠেছিল স্বনির্ভর আন্দোলন। বৈষম্যহীন সমতাভিত্তিক একটি দেশের স্বপ্ন নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের উদ্যমী তরুণরা বিভিন্নভাবে কাজ করেছিল। ফলে দুর্ভিক্ষের প্রকট প্রভাব সত্ত্বেও শেন্ডেল বাংলাদেশের বাতাসে এক ধরণের আশাবাদের, পরিবর্তনের লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন।

শেন্ডেল বাংলাদেশ নিয়ে গোটা দশেক বই লিখেছেন। তিনি প্রথমে বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র কৃষক পরিবারের ইতিহাস রচনার মাধ্যমে শুরু করেন (Peasant Mobility,1993)। সেখানে চেষ্টা করেন কিভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এসব পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। বাংলাদেশের সমাজ গ্রামভিত্তিক হলেও গ্রামের ইতিহাস রচিত হয়নি, হয়েছে মূলত গ্রামের জোতদার, জমিদার, ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের ইতিহাস। শেন্ডেল তাঁর গবেষণায় বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবনকে গুরুত্বের সঙ্গে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। ফলে অবহেলিত-শোষিত মানুষই তার গবেষণার বিষয়বস্তু হয়ে উঠে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের নিয়ে তিনি গবেষণা করেন। 

তাঁর একটি গবেষণার বিষয় ‘সময়’, যেখানে তিনি বলেন বাংলাদেশ খুব ব্যতিক্রমীভাবে একটি সময়-সমৃদ্ধ (Time-Rich) দেশ। ইউরোপীয় সমাজ যেখানে একটি সময়কাঠামোতে চলে সেখানে বাংলাদেশী সমাজ অনায়াসে তিনটি সময়কাঠামো বজায় রেখেছে। সম্পূর্ণ পৃথক কাঠামো হলেও এ দেশে বাংলা, ইংরেজি এবং ইসলামি এই তিন রকম ক্যালেন্ডারই ব্যবহৃত হয়। খাসিয়াদের ৮ দিনে সপ্তাহ। বাংলাদেশের মানুষ এই বিভিন্ন ধরণের সময়কাঠামো যেভাবে তাদের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক জীবনে ব্যবহার করে, তা  পর্যবেক্ষণ করলে এ দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের পদ্ধতি , ক্ষমতাকাঠামোর খেলা, পরিচয়ের সংকট এসব নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব।

শেন্ডেলের সব কাজের একটি সমন্বিত রূপ পেয়েছে ২০০৯ সালে প্রকাশিত তার ‘A History of Bangladesh’ বইতে। বইটিতে মোটাদাগে চারটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ইকোলজি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি। প্রথম ভাগে তিনি এ অঞ্চলের ভৌগোলিক গঠনপ্রক্রিয়া- যেমন মাটি, পানি, বনজঙ্গল, শহর ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছেন।  অতি প্রাচীনকাল থেকে ধ্বংসাত্বক এবং গঠনমূলক প্রক্রিয়ার ফলে এ অঞ্চলের একটি স্বতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য তৈরী হয়েছে। রিচার্ড ইটনের ধারণাকে ভিত্তি করে তিনি এ অঞ্চলের কৃষি, ধর্ম, ভাষা সম্পর্কে তুলনামূলক আলোচনা করেন। দ্বিতীয় ভাগে মোগল আমল থেকে বৃটিশ শাসন, ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব এবং পরের ভাগে দেশভাগ-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে আলোচনা করেছেন। চতুর্থ ভাগে তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা করেছেন। সর্বশেষ ভাগে তিনি বর্তমান (২০০৭) বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন।   শেন্ডেল মূলত বাংলাদেশের ইতিহাসের নবদিক উন্মোচনকারী ইতিহাসবিদ। তিনি চেষ্টা করেছেন বড় বড় জাতীয় বীরের বদলে সাধারণ মানুষের ইতিহাস লিখতে, যাতে বাংলাদেশের জটিল ইতিহাসকে একটা ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বোঝা যায়। অসম্ভব বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে এখানে সাধারণ মানুষকে সংগ্রাম করতে হয় কিন্তু এর মাঝেই তারা ধরে রেখেছে অসীম সাহস, আন্তরিকতা আর স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণশক্তি। তবে আন্তর্জাতিক জনসংযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সীমাহীন দুর্বল। যেমন ভাষা নিয়ে গর্ব থাকলেও তা আন্তর্জাতিকমানে উন্নীত করতে পারেনি। বাংলাদেশের অসাধারণ মানবিক সম্ভাবনা রয়েছে আবার সেই সম্ভাবনার সীমাহীন অপচয়ও হচ্ছে। তবুও সবশেষে তিনি তরুণদের উপর ভরসা রেখেছেন। ইতিহাস নিয়ে তরুণদের এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন। 

cross-circle