গল্পের পৃথিবী
জুলাই ২৫, ২০১৭

২৭৩ তম সাপ্তাহিক পাবলিক লেকচার

বিষয়: গল্পের পৃথিবী

বক্তা: কিঙ্কর আহসান

তারিখ: ২১ জুলাই, ২০১৭

পৃথিবী অসংখ্য ছোট ছোট গল্প দিয়ে তৈরি। মা-বাবার গল্প, ভাই-বোনের গল্প, প্রেমিক-প্রেমিকার গল্প, বন্ধুত্ব ও বৈরিতার গল্প, রাজনৈতিক কিংবা নিতান্ত শিল্প-সৌন্দর্যের পূজারী গল্প, স্বদেশীয় কিংবা আর্ন্তজাতিক গল্প, কালিক কিংবা ধ্রুপদী গল্প। এই গল্পগুলো আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে,  জীবনযাপনের ধারা কেমন হবে তা নির্ধারণ করে। অস্থিরতার পৃথিবীতে একটা ভালো গল্প হয়ে ওঠে আমাদের আশ্রয়স্থল। আমরা ইতিবাচক চিন্তা করতে শিখি। একটা খারাপ গল্প আবার করোটিতে প্রবেশ করে আমাদের অন্ধকার পৃথিবীর দিকে নিয়ে যায়। আমরা অসহায়বোধ করি। 

জীবনে আমাদের গল্পের এই প্রভাব দেখে ব্যবসা করছে অনেকেই। দেদারসে চলছে বিকিকিনি। অপ্রয়োজনীয় গল্পের ঝাঁ-চকচকে দোকান খুলে বসেছে দোকানদাররা। এই সব গল্প থেকে শিখে আমরা একটা ধার করা জীবন যাপন করছি। নিজেদেরকে হারিয়ে চকচকে জীবনের নেশায়, হীনমন্যতার পরিচয় দিয়ে নিজেকে জাহির করার এক অসম্ভব খেলায় মেতে উঠছি সবাই। বিজ্ঞাপন, সিনেমার খারাপ গল্পের ফাঁদে পড়ে বই পড়ার চেয়ে প্রোফাইল পিকচার বদলানো জরুরী হয়ে উঠেছে, আন্তরিক চুম্বনের চেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে চেক ইন দেওয়া, আড্ডার চেয়েও প্রয়োজনীয় চ্যাটবক্স, অনলাইন। কেমন একটা মুখোশ পড়ে ঘুরতে হচ্ছে সারাদিন। নিজস্বতা হারিয়ে অপরের বানানো-দেখানো গল্পে ভেসে ভেসে পথ চলছি আমরা,। নষ্ট হচ্ছি। ধ্বংস হচ্ছি। পঁচে যাচ্ছি। পঁচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছি কিন্তু টের পাচ্ছি না। নিজের অজান্তে গল্প কিনে বেড়াচ্ছি আর বখাটে গল্পের জন্ম দিয়ে যাচ্ছি। নতুন কিছু নেই।  

নিজের সৎ গল্পের বুনিয়াদ সবচেয়ে মজবুত। তার ওপর দাঁড়ালে আলাদা হওয়া যায়। অথচ আমরা, আমি এলোমেলো গল্পের ভিড়ে খেই হারিয়ে একদম নাস্তানাবুদ শেষে। বইয়ের জায়গা এখন জাদুঘরে। পড়াশোনায় বিশেষ অনুরাগ নেই। ওসব পিছিয়ে পড়া মানুষের কারবার। লাইফস্টাইল প্রয়োজন। প্রয়োজন খুব বেশি গ্ল্যামার। গল্পের পৃথিবীতে নিজের, নিজেদের গল্পগুলো গ্ল্যামারাস হয়ে উঠছে না। কোথায় প্রোডাক্ট ঢুকবে, ব্র্যান্ড-এর সাথে ফিট ইন কিনা সেই যুক্তি বাদ দিয়ে বিক্রির আশায় তুলে দিচ্ছে যাচ্ছেতাই। দিনশেষে সারবত্তা কিছু নেই। দিনশেষে গল্পের প্রবল শক্তি টের পাওয়া যায় না। লড়াই করবার সময় চলে এসেছে। ঝুঁকে আর একদিনও নয়। একটা লোকাল গল্প বলে দেশের বাইরে ১৪০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয়েছে কিছুদিন আগে শুধু সততার জন্য। ভালো কিছুর সমাদর সব জায়গায়। আমরা কেন জানি বড্ড হীনমন্যতায় মরীচিকার পেছনে ছুটে মরছি। নিজের জীবনটাকে নিজের মতন করে যাপন করা প্রয়োজন হয়ে উঠেছে।

প্রয়োজন হয়ে উঠেছে একটু মেডিটেশন, সুস্থির হওয়া। নিজেকে চেনাটা জরুরী। নিজের গল্পেই এর পরিত্রাণ। নিজেদের গল্পেই শেকড়ের কথা আছে। সিন্ডিকেট, লবিং, পিআর, প্রচুর মিডিয়া বায়িং, হুড়োহুড়ি করে মানুষের কাছে যাওয়া যাচ্ছে বটে, তবে তার কোনোকিছুই মানুষের অন্তরের কাছে পৌঁছানোর জন্য জরুরী নয়। অযথা গল্প বলে আর অবিশ্বাসের দেয়াল না তোলাই ভালো। ক্ষান্ত দিয়ে অস্থির একটা সময়কে বরং শান্ত করবার সময় চলে এসেছে। তার জন্য গেরিলা-মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে নতুন সব সারপ্রাইজ নিয়ে বাজারে ঢোকার প্রাণপণ চেষ্টা করছে কিছু হাতেগোনা মানুষ। কেনো করছি, কী করছি সেসব প্রশ্নের উত্তর গল্পের ভেতর দিয়েই গল্পটাকে নিজের সাথে যুক্ত করানোর চেষ্টায় দিনভর সংগ্রাম চলছে। ফলাফল এতে আহামরি না হলেও শূন্য নয়। মননের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা যতটা না নিজের জন্য বাঁচি, তার চেয়েও বেশি অন্যের জন্য বাঁচি। এই বেঁচে থাকা, দিন পার করবার জন্য মানবজাতিকে নিজ নিজ গল্পের কাছে ফিরতেই হবে। নিজের গল্পের কাছে আশ্রয় নিতেই হবে। আর না হলে খুব শীঘ্রই গল্পকাররা হয়ে উঠবেন দুষ্প্রাপ্য। গল্পগুলো হয়ে যাবে বিলুপ্ত। 

cross-circle