নলেজকালচার হলো রিডিং ক্লাবের প্রাত্যহিক সেশন। প্রতিদিন রাত নয়টায় নীলক্ষেত মোড়ে চা খেতে খেতে জ্ঞানের বিভিন্ন ডিসিপ্লিন বিষয়ে আলোচনা করা হয়। এই সেশনে যে-কেউ অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে যারা ভাসা ভাসা পড়াশুনা করেন ও পরিবেশিত তথ্যের অনেকক্ষেত্রেই যারা অনুমান নির্ভর কথা বলেন তাদেরকে এই সেশনে অংশগ্রহণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে রিডিং ক্লাবের সকল আলোচনাই তথ্য ও আত্মবিশ্বাস নির্ভর। জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে যারা ‘সিরিয়াস’ নয় তাদের রিডিং ক্লাবকে এড়িয়ে চলা উচিত! নলেজকালচারের উদ্দেশ্য হল বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর ও চিন্তার সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তার অপর নাম হলো সামষ্টিক চিন্তা (কালেকটিভ্ থিঙ্কিং)। ইউরোপে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চর্চার সঙ্ঘবদ্ধ রূপটির সবচেয়ে বলিষ্ঠ বিকাশ ও প্রকাশ ঘটেছে আঠারো ও ঊনিশ শতকে। বাংলায় এই জাতীয় চিন্তা চর্চার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য কৃতিত্বের দাবিদার হলেন হেনরি ডিরোজিও (১৮০৯-১৮৩১) ও তাঁর শিষ্যরা। পূর্ববঙ্গে এই ক্ষেত্রে পথিকৃৎ আবুল হুসেনের (১৮৯৬-১৯৩৮) নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত শিখা গোষ্ঠী (১৯২৬)। রিডিং ক্লাবের অ্যাসোসিয়েটরা নলেজকালচারে চা খেতে খেতে বাংলাদেশের মানুষের উদ্ভব ও বিকাশ, ঐশ্বর্য ও দারিদ্র্য, গৌরব ও লজ্জা, শক্তি ও দুর্বলতা, সম্পদ ও সমস্যা, আনন্দ ও যন্ত্রণা, দোষ ও গুণ, ভয় ও ভরসা, প্রীতি ও ঘৃণা, দ্বেষ ও দ্বন্দ্ব, আশা ও নৈরাশ্য, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মগ্লানি, আত্মসম্মানবোধ ও আত্মরতি, আদর্শবাদ ও নীতিহীনতা, সুকৃতি ও দুঃকৃতি, সংগ্রাম ও পরবশ্যতা, স্বদেশ ও স্বজাতির অন্তরঙ্গ পরিচয়ের তথা স্বরূপের অভিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করে। চা পানের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চর্চার কোনো বাস্তব আবশ্যিক যোগসূত্র নেই বটে, তবে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চর্চার সঙ্গে চা-এর একটি সিম্বলিক বা প্রতীকী সম্পর্ক আছে নিশ্চিত। বলা হয় ইউরোপের মননে ও মগজে এজ অব এনলাইটেনমেন্ট বা এজ অব রিজন নামে যে-বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব সাধিত হয়েছিল তার পেছনে চা ও কফি স্টলগুলোর যথেষ্ট অবদান ছিল। চা স্টলগুলো সমাজের মানুষের, চিন্তকদের সঙ্ঘবদ্ধ চিন্তা চর্চার জন্য প্রকৃষ্ট জায়গা।
“ঊনিশ শতকের দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ‘ক্যালকাটা গেজেট’ ও অন্যান্য পত্রিকায় কলকাতার বৌবাজার-লালবাজার অঞ্চলে প্রচুর ট্যাভার্ন-কফিহাউসের বিজ্ঞাপন দেখা যায়। হার্মনিক, ক্রাউন অ্যাঙ্কর, ব্রিটিশ কফিহাউস-এইরকম সব নাম। এই ট্যাভার্ন ও কফিহাউসগুলি আমাদের স্বদেশীয় সমাজের স্বাভাবিক দৃশ্য নয়, আঠারো শতকের জনসনের ইংল্যান্ডের সামাজিক দৃশ্যের একটা প্রতিচ্ছবি মাত্র, লন্ডনের বদলে কলকাতার রঙ্গমঞ্চে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন: The Coffee-houses became the first centers of opinion in a partially democratized society