শ্রমজীবীদের আয়-বৈষম্য ও মজুরি বঞ্চনা নিরসনে অর্থনৈতিক সংস্কার জরুরি। ‘উৎপাদন সম্পর্ক পুনর্গঠন: রাষ্ট্র-সংস্কারের অবহেলিত অধ্যায়’ শীর্ষক পাবলিক লেকচারে কৃষক-শ্রমিকদের আয়-বৈষম্য ও মজুরি-বঞ্চনার নিরসনের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ মন্তব্য করেন লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ। পাবলিক লেকচারটি রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের উদ্যোগে গত ০৮ অক্টোবর, ২০২৪ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়।
বক্তৃতায় তিনি বলেন, সংস্কারের রূপকল্প তৈরি করতে সরকারিভাবে ছয়টি কমিশন গঠন করা হয়েছে সম্প্রতি। এগুলো মূলত রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোর সংস্কার। রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত সংস্কার করতে হলে প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কার । তিনি অর্থনীতির কাঠামোগত কারণে সৃষ্ট আয়-বৈষম্য ও মজুরি বঞ্চনা নিরসনে অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য একটি কমিশন গঠন করার পরামর্শ দেন।
বক্তা আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছর বিভিন্ন শিল্প খাতে মাঝেমধ্যে মজুরি বাড়লেও সেটা এত অল্প বেড়েছে যে প্রতিবারই ‘প্রকৃত মজুরি’ ছিল প্রায় নতুন মজুরির কম। সবচেয়ে বড় বিষয়, শ্রমিকেরা শান্তিতে মজুরি বাড়ানোর কথা বলতে পারতেন না মামলা-মোকদ্দমার ভয়ে। শ্রমিক সংগঠকদের গুম হয়ে যাওয়ার নজিরও আছে। অথচ একই সময়ে ব্যবসায়ী ও শিল্পকারখানার মালিকেরা বেশি বেশি করে পার্লামেন্টের সদস্য হয়েছেন। সর্বশেষ জাতীয় সংসদে ১৯৯ জন ছিলেন ব্যবসায়ের জগতের মানুষ। আগের সংসদে এই সংখ্যা ছিল ১৮২ জন। মালিক শ্রেণির প্রতিনিধিরা যে দেশের নীতিনির্ধারণে এক-তৃতীয়াংশ থাকেন, সেখানে শ্রমিক স্বার্থে জাতীয় সিদ্ধান্ত হওয়ার নয়। হয়ওনি।’
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক জরিপকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, সমাজের সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় দেশের মোট আয়ের ১ দশমিক ৩১ শতাংশ মাত্র। আর একদম ওপরতলার ১০ শতাংশের আয় দেশের মোট আয়ের ৪১ শতাংশ। একজন গরিবের তুলনায় একজন ধনীর আয় অন্তত ১১৯ গুণ বেশি। একজন গরিব ১ টাকা আয় করলে একজন ধনী আয় করেন ১১৯ টাকা। এই চরম আয়-বৈষম্য হ্রাস করার জন্য অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ না নিলে শ্রমজীবীদের মাঝে ক্ষোভ জিইয়ে থাকবে, আবারও কোনো অভ্যুত্থানের অংশীদার হবে তারা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণের তাৎপর্য সম্পর্কে আলতাফ পারভেজ বলেন, আন্দোলনকালে যে জায়গাটিকে ‘প্রতিরোধের লেনিনগ্রাদ’ বলা হতো, সেই যাত্রাবাড়ী এলাকায় কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। এটা মুখ্যত শ্রমজীবীদের এলাকা। এখানকার মানুষ কেন জীবন বাজি রেখে রাস্তায় নেমেছিলেন? তাঁরা কেন অকাতরে জীবন দিলেন? উত্তর অনুমান করা কঠিন নয়। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের ভেতর দিয়ে দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেট ও প্রতিদিনকার পুলিশি চাঁদাবাজির মতো সমস্যাগুলো দূর হবে; তাঁদের মজুরি বঞ্চনার অবসান ঘটবে। আদৌ হবে কি সেসব? কোন প্রক্রিয়ায়?
কৃষি প্রশ্নে তিনি বলেন, কৃষি আর্থিকভাবে অলাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। কৃষি জমিগুলো ক্রমাগত চাষাবাদে অনুপস্থিত শহুরে মালিকদের দখলে যাচ্ছে। এত দিন এটাকে উন্নতি বলা হয়েছে। অথচ গ্রামজুড়ে কাজের অভাব। এর সমাধানে তিনি বর্গা ব্যবস্থার পরিবর্তনে পরামর্শ দেন।
উক্ত আলোচনায় দুর্যাগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা, রিডিং অ্যাসোসিয়েটবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং নানা শ্রেণি পেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটির উন্মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্ব সঞ্চালনা করেন রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী জনাব জুলফিকার ইসলাম।