‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’ বলতে কী বোঝায়?
জানুয়ারি ১৮, ২০১৯

মোহাম্মদ আজম

প্রাককথন

এই বক্তৃতায় আমরা শিক্ষার নিপীড়ক বা কোয়ার্সিভ বৈশিষ্ট্য নিয়ে কথা বলব না। ধরে নেব, মানুষের হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতা থেকে কল্যাণের ধারণাবশত শিক্ষার পদ্ধতিগুলো ঠিক হয়েছে এবং তাতে মানব সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে আমাদের সম্মতিও আছে।

উচ্চশিক্ষার সাথে গবেষণা তথা নতুন জ্ঞান উৎপাদনের সম্পর্কটিও আমরা এখানে কম আমলে আনব। উল্লেখ থাকবে, কারণ ওই অংশ ছাড়া উচ্চশিক্ষার আলোচনা চলতেই পারে না। কিন্তু আমরা আলাপ চালাব বিশেষভাবে - স্নাতক সম্মান পর্যায়ের পড়াশোনা নিয়ে, যাকে আজকাল ব্যাপকভাবে আন্ডারগ্র্যাড নামে ডাকা হয়।

দুনিয়াজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সময়কাল সাধারণভাবে ষোল বছর ধরা হয়। বার বছরের পড়ার পর আরো চার বছর। এই চার বছরকে আমরা উচ্চশিক্ষা বলতে পারি। ধরে নেয়া হয়, অধিকতর পড়াশোনা খুব কম লোক করবে, অথবা খুব নির্দিষ্ট প্রয়োজনে কেউ কেউ করবে।

আমাদের পুরানা সার্টিফিকেট বা ডিগ্রিগুলোর নাম বেশ সুন্দর ছিল। এন্ট্রান্স, এফ এ, বি এ [স্নাতক], এম এ [স্নাতকোত্তর]। নামগুলোর মধ্যে কী পড়ানো হবে, লক্ষ্যই বা কী  তার একটা ইশারা আছে।

মাদ্রাসার বর্তমান নামগুলোও তাৎপর্যবহ : দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল।

বাংলাদেশের মূলধারার শিক্ষার নামগুলো চলনসই। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। কর্তারা একটু ভেজাল করে ফেলেছে বাড়তি সার্টিফিকেট পরীক্ষা যোগ করে। তবে তারা জানে, আট বছর আর চার বছর মিলে বার বছর করতে হয়। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তক রচনায় এ বাবদ বেশ বদলও এসেছে। কিন্তু পর্ব চিহ্নিতকরণে তারা গোলমালের অবসান ঘটাতে পারেনি। দশ বছর আগে নাহিদ সাহেব সাড়ম্বরে এই ঘোষণা দিয়েছিলেন। কাজ হয়নি। কারণ ঘোষণাটা ছিল ধার করা। অন্যরা করে, তাই আমাদেরও করতে হবে, ইত্যাদি। আমাদের বাস্তব থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। নেয়া দরকার।

যাই হোক, ১২ বছরের পর ৪ বছরের পরিকল্পনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ধরে নেয়া হচ্ছে, কেউ একজন বার বছর প্রস্তুতি নিয়ে উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশ করছে এবং আরো চার বছরের চর্চা শেষ করে ছড়িয়ে পড়ছে কর্মক্ষেত্রে বা জীবনের বৃহৎ পরিসরে। মানুষের আয়ু, কর্মক্ষমতা এবং ব্যক্তির সাথে সমষ্টির সম্পর্ক ইত্যাদির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকেই এ সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে।

চার বছরের পর এক বা দুই বছরের মাস্টার্স এবং কয়েক বছরের পিএইচ ডি ডিগ্রিও উচ্চশিক্ষার কাতারে পড়ে। সে আলোচনায় আমরা এখন যাব না। কারণ ভালো স্নাতক ডিগ্রির সাথে এ দুই ডিগ্রির বিরোধ তো নাই-ই, বরং স্নাতকের ভিত্তিই মাস্টার্স এবং পিএইচ ডি-র জন্য জরুরি। ফলে ভালো স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আমাদের আলাপকে ‘গবেষণা পরে’-ধরনের সিদ্ধান্ত হিসাবে নেয়া মোটেই সঙ্গত হবে না।

এখানে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক ধরনের সংজ্ঞায়ন করা দরকার। দুনিয়ার বহু ‘কলেজ’ চোস্ত  স্নাতক ডিগ্রি পয়দা করে। এগুলো শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়া। তবে ১২ বছরের পর ২ বছরের ডিগ্রি দেয়ার ব্যবস্থা আছে বহু প্রতিষ্ঠানে। লক্ষ্য, খানিকটা বাড়তি ‘সাধারণ’ স্কিল যুক্ত করে ‘জনশক্তি’ তৈরি করা। এগুলোকে আমরা বলব কলেজ। এর সাথে বৃত্তিমূলক শিক্ষার উদ্দেশ্যগত সাদৃশ্য আছে। যদিও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মতো কলেজের ২ বছরের ডিগ্রি বিশেষায়িত নয়।

গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের সাথেও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ফারাক চিহ্নিত করে রাখা জরুরি। বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বহু গবেষণা-প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠে। এগুলোর ফলও বেশ দৃষ্টি-আকর্ষক। সে ক্ষেত্রে মূল ফারাকটা আমরা করব শিক্ষার্থীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি দিয়ে; আর নির্দিষ্ট সময়কাল এবং পাঠক্রমের ডিগ্রি দিয়ে। আমরা আমাদের বর্তমান আলোচনার সাথে মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কেই বাড়তি মর্যাদা ও গুরুত্ব দেব। কারণ, এর সাথে ‘জনশক্তি’ উৎপাদনের সম্পর্ক আছে, যা শেষ পর্যন্ত জনগণ ও সমাজ পর্যন্ত গড়াবে; আর বিশ্ববিদ্যালয়েই কেবল অব্যবহিত লাভ নেই এমন বিদ্যাচর্চা সম্ভব। সার্বিকভাবে মানবপ্রগতির জন্য এ বস্তু দরকার, তা যতই না আমরা নিও-লিবারেল জমানার উদ্দেশ্যমুখিনতায় বাস করি।

সাধারণভাবে ১২ বছরের স্কুলিং শেষ করে একজন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে ১৮ বছর বয়সে। সংখ্যাটি যে তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধির সাথে অভিজ্ঞতা যুক্ত হয়ে একজন শিক্ষার্থী তখন প্রস্তুত হয়ে ওঠে। কী জন্য? খোঁজ নেয়ার স্বার্থে একবার প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ঘুরে আসা দরকার।

প্রাথমিক শিক্ষায় পড়ানো হয় সবচেয়ে মীমাংসিত, সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলো। শিখনফল ‘ওয়ান টু ওয়ান’, এ অর্থে যে, যা দেয়া হচ্ছে তা ফেরত পেলেই ভালো শিক্ষা হয়। প্রাথমিকের শিক্ষা মূলত ভাষা-  বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাংলা, ইংরেজি ও গণিত; এবং যাপিত জীবনের ভাষার মধ্যে স্বীকৃত আরো কিছু বিষয়, যাকে আমরা সাধারণ জ্ঞান বা কাণ্ডজ্ঞান বা নাগরিকের জ্ঞান নামে ডাকতে পারি।

মাধ্যমিক বা সেকেন্ডারির চার বছরে আগের ধারা অব্যাহত থাকবে, তবে শিক্ষার্থীরা ক্রমশ প্রবেশ করবে ‘বিষয়ে’। উদ্দেশ্য প্রধানত দুটি : পরবর্তী শিক্ষার জন্য মানসিক-সাংস্কৃতিকভাবে প্রস্তুত হওয়া এবং পরবর্তী শিক্ষার জন্য স্কিল বা কৌশল রপ্ত করা।

যাকে আমরা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’ বলি, তা আবশ্যিকভাবে ডিসিপ্লিন বা বিষয়ে বিভক্ত; কারণ, ধরেই নেয়া হয়, এর যে কাজ, এর যা উদ্দেশ্য তা পরিপূরণের জন্য একটা ছোট পরিসর বেছে নিতে হবে, যা শুধু আকারে ছোট নয়, প্রকারের দিক থেকেও অন্যগুলো থেকে স্বতন্ত্র।

স্নাতক পর্যায়ে পড়া বলতে প্রধানত বোঝায় : যে বিষয়টি পড়ছি তার সাথে যুক্ত [অন্তত] প্রভাবশালী মতগুলোর সাথে পরিচয়, এবং সে মতগুলোর উৎপাদনপদ্ধতির সাথে পরিচয়- কিছুতেই নিজের মত উৎপাদন নয়।

সরল হোক বা জটিল হোক, এই বাক্যই আমাদের আজকের বক্তৃতার মূল বাক্য। আরো কয়েকভাবে বাক্যটি পুনরুৎপাদন করা যাক।

এই যে বহুমতের সাথে পরিচিত হওয়া এবং সেগুলো পরিপ্রেক্ষিতসহ উপস্থাপন করতে পারা, এর বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য অপরিসীম। এটি বিকল্পের ধারণা দৃঢ়মূল করে মৌলবাদকে নিরুৎসাহিত করে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চা নিশ্চিত করে। বহুমতের সহাবস্থান ভাবতে অভ্যস্ত করে যে, সমাধান কোনো একক মতে নেই, বরং আছে বহুমতের পর্যালোচনায়। কিন্তু যে এ ধরনের পর্যালোচনায় অভিজ্ঞ, তার পক্ষে উপস্থিত সমস্যার মীমাংসা করা খুবই সম্ভব।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যে সূত্র আমরা এখানে প্রস্তাব করলাম, তার অনিবার্য পরিণতি বই পড়া। বই পড়া মানে মত বা সিদ্ধান্ত জানা নয়। বরং যে পদ্ধতিতে একজন সিদ্ধান্ত নেয় তার সাথে পরিচিত হওয়া। যে দৃষ্টিভঙ্গিতে সিদ্ধান্ত ভিন্ন হয় তার খবর নেয়া। বলা দরকার, আন্ডারগ্র্যাড পর্যায়ের এই বই পড়াই সমাজে বই পড়া সংস্কৃতির গভীরতা ও কার্যকরতা তৈরি করে।

গ্রামসির ‘কমন সেন্স এবং গুড সেন্স’ ধারণা ব্যবহার করে কথাটাকে এভাবে বলা যায় : আমরা যাপনসূত্রে বাস করি কমন সেন্সের জগতে। বৃহত্তর অর্থে ভাষার জগৎ থেকেই আমরা সেই কমন সেন্স আহরণ করি। কিন্তু চিন্তার পদ্ধতি, কলাকৌশল এবং ইতিহাস জানার মধ্য দিয়েই আমরা প্রবেশ করি গুড সেন্সের জগতে। বলা যায়, আমরা বাস করি হরেদরে সাবজেক্টিভিটির জগতে। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’র যে তরিকা আমরা উপরে প্রকাশ করলাম, তার মধ্য দিয়েই আমরা প্রবেশ করি প্রয়োজনীয় অবজেক্টিভিটির স্তরে, রাষ্ট্র তো বটেই সমাজের সুষ্ঠু চলনের জন্যও যে অবজেক্টিভিটি প্রায় প্রাথমিক শর্ত।

কথাটাকে প্রশ্ন এবং উত্তরের রূপকেও প্রকাশ করা সম্ভব। কমন সেন্সের জগৎ থেকে আমরা যেসব প্রশ্ন করি তা সাধারণভাবে তথ্যনির্ভর এবং একক উত্তরই তার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু যে প্রশ্ন জন্মে সত্তার গভীর থেকে, যে প্রশ্নে লেগে থাকে ব্যাপক খোঁড়াখুঁড়ির রক্তাক্ত চিহ্ন, সে প্রশ্নের কোনো এক কথার উত্তর হতে পারে না। একমাত্র অগভীর সমাজের অগভীর ব্যক্তি বা সমষ্টিই এ ধরনের প্রশ্ন ও উত্তরে তৃপ্ত হতে পারে। বিপরীতে, যে প্রশ্ন বিশ্লেষণাত্মক, সে প্রশ্নের উত্তরও হবে বিশ্লেষণমূলক নানা বিকল্প- এ চর্চা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়েই চলতে পারে, যা ক্রমশ সঞ্চারিত হবে সমাজদেহে।

তো, এই পড়াশোনার অব্যবহিত লক্ষ্য কী? লক্ষ্য স্কিল হাসিল করা। মানে কী? মানে কোনো বিষয়ের পরিভাষা ও কলাকৌশল রপ্ত করা এবং ওই বিষয়ের ইতিহাস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা। কৌশল রপ্ত করার পর গ্র্যাজুয়েটরা প্রবেশ করবে কর্মক্ষেত্রে। ছড়িয়ে পড়বে বৃহৎ সমাজের প্রাত্যহিক জীবনে। সাথে থাকবে তার অর্জিত পাঠ-সংস্কৃতি এবং দৃষ্টিভঙ্গি। অন্য ছোট একটি অংশ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রবেশ করবে নতুন জ্ঞান উৎপাদনের প্রক্রিয়ায়।

বাংলাদেশে, নানা লক্ষণ থেকে নিশ্চিত করে বলা যায়, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বোক্ত চর্চায় হয় প্রবেশ করিনি বা সামান্যই করেছি।

মধ্যবিত্তের বিকাশের ইতিহাসের দিক থেকে এর কারণ ব্যাখ্যা করা কঠিন নয়। পশ্চাৎপদ কৃষকসমাজ-উদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী সংখ্যাধিক্যের জোরে গত শতকে বেশ ক-বার প্রায় মুফতে সুবিধা পেয়েছিল- এ তথ্য ব্যাপারটাকে অন্তত আংশিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারবে। বিশ শতকের গোড়ায় এ অঞ্চলের মানুষ সংখ্যাধিক্যের জোরে কোটার সুবিধা পেয়েছিল। পাকিস্তান পর্বে অযোগ্যদের ভরাট করতে হয়েছিল শূন্যস্থান, আর উপস্থিত ছিল বঞ্চনার রেটরিক। বাংলাদেশ পর্বে আমরা প্রবেশ করেছি নিজেদের অপ্রস্তুতির রাজ্যে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়সুলভ চর্চার অনুপস্থিতি এবং মধ্যবিত্তের অপ্রস্তুতি পরস্পরকে শক্তিশালী করেছে।

আমাদের প্রতিবেশী বাংলার ভাই-বোন-বন্ধুদের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। কলোনিয়াল শাসনে সম্মত কলকাতার ভাই-বেরাদরদের টিকে থাকতে হয়েছিল প্রভুদের সাথে লড়াই করে। ফলে তাদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’য় গতি ও গভীরতা অর্জিত হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে কলোনিয়াল হ্যাঙওভারবশত বিপুল জনগোষ্ঠীর সাথে একাত্মতা প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও তাদের ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’র সংস্কৃতি যে অব্যাহত থেকেছে, তার প্রমাণ প্রতিনিয়ত পাচ্ছি।

বাংলাদেশে কিন্তু আমরা নিজেদের দিকে নিজেদের মতো করে তাকাতে শিখিনি। দেদার ধার করেছি। আমরা ধরেই নিয়েছি, রাষ্ট্র চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং সমাজ গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ আসবে পশ্চিম থেকে। ঔপনিবেশিক অপর হিসাবে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাই নিঃসন্দেহে এ অবস্থার কারণ।

আমরা রাষ্ট্র চালাই হয় কোনো ধারণা ছাড়াই অথবা বিশ্বব্যাংক বা অনুরূপ কোনো কোনো পশ্চিমের ফতোয়া মোতাবেক। তাতে ‘কাজ’ চলছে। বিশ্বপুঁজির ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা সেবাখাতকে সেবা দেয়ার জন্য আমাদের গ্র্যাজুয়েটরাই যথেষ্ট। মুশকিল হয় একেবারে বাস্তব অভাব থেকে। সেবাখাতের উঁচু পদগুলোতে বা পরিকল্পনা প্রণয়নকারী রূপে বা উঁচু কৌশল দরকার হয় এমন চাকরিগুলোতে আমাদের ধার করতে হয় বিদেশি ‘গ্র্যাজুয়েট’। বস্তুত এ ধরনের পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য যে ধরনের শিক্ষা-আয়োজন দরকার, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে ধরনের সক্ষমতা কখনোই অর্জন করেনি।

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতি মাত্রায় অনমনীয় বা রিজিড, যা ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ ধারণার পরিপন্থি। একই বয়সে ভর্তি এবং পাশ, একই বিষয়ে পাঁচ বছর, বিকল্পহীন ছাঁচে একটি জীবন। অথচ দুনিয়াজুড়ে এখন মেজর-ননমেজর এবং একই সাথে একাধিক ডিগ্রির ছড়াছড়ি। আর আমাদের এখানে মাস্টার্সটাও অন্য বিষয়ে করার সুযোগ নেই। ঘানির বলদের মতো অবস্থা। এই রিজিডিটি আমাদের সমাজেরই প্রতীকী প্রকাশ- ব্যক্তির ব্যক্তিত্বকে বা স্বাধীনতাকে চূড়ান্ত মাত্রায় বেঁধে রাখার প্রাণান্তকর প্রয়াস। সমাজে তা ভাঙা কঠিন, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় বৃত্তিমূলক শিক্ষার মানসিকতা ছেড়ে ‘বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা’য় প্রবেশ করলে তা সমাজকেও প্রভাবিত করবে বলে আশা করা যায়।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে বৃত্তিমূলকতার যে প্রবল প্রতাপ, তার দুটি উদাহরণ দিয়ে আলোচনা শেষ করছি।  এক. বই পড়া ছাড়াই আমরা ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি’। এবং আমাদের ‘লাইব্রেরি’ নেই। দুই. আমরা শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে এক বালসুলভ ডিসকোর্স প্রভাবশালী করে রেখেছি। বাংলা আর ইংরেজিকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মজা লুটছি। আমরা পড়ব বাংলায়, কারণ আমাদের ‘বুঝ’ দরকার, আর উত্তমরূপে শিখব ইংরেজি, কারণ আমাদের পড়া দরকার, চাকরি দরকার- সারা দুনিয়ায় প্রচলিত [ভারত ব্যতিক্রম, তার পরিস্থিতি ভিন্ন এবং ওই পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের কোনো মিল নেই।] এই সরল নিয়মকে পাত্তা না দিয়ে আমরা হিজিবিজি ইংরেজিতে আন্ডারগ্র্যাড সাজিয়েছি। আমাদের নির্লজ্জ কর্তারা অবশ্য পরিষ্কার করেই বলে, সিদ্ধান্তটা এসেছে বৃত্তিমূলকতার প্রয়োজনে। সে ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় নাম বাদ দিয়ে ‘কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করলে বা বৃত্তিমূলক প্রতিষ্ঠান চালালেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

শেষ হয়েও হল না শেষ

শেষ না হওয়ার মূল কারণ, আমরা কথা বলেছি পশ্চিমা সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে। সেখানে সমাজের প্রচণ্ড চাপে বিশ্ববিদ্যালয় এরকম রূপ পেয়েছিল। কিন্তু আমরা প্রস্তাব করেছি, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’র মধ্য দিয়ে সমাজদেহের রূপান্তর। আমার প্রস্তাব, আমাদের জন্য এই একটি পথই খোলা আছে। আমাদের দরকার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ- মিথ-আক্রান্ত সমাজ নয়। দরকার পড়া - মত বা সিদ্ধান্ত জানা নয়। দরকার লিবারেল দৃষ্টিভঙ্গি এবং তা থেকে উদ্ভূত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। দরকার ফ্যাশনের বাইরে গিয়ে কিংবা শ্লোগানের বিপরীতে অনুসন্ধানময় জনগোষ্ঠী। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া’ ছাড়া ‘কোথায় পাব তারে’?                       

cross-circle