রিডিং ক্লাব ট্রাস্টের ৮ম মাসিক লেকচার
বাংলায় মুসলিম মধ্যবিত্তের উন্মেষ ও বিকাশ
বক্তাঃ ডঃ গোলাম মুরশিদ
সভাপতিঃ ডঃ সিরাজুল ইসলাম
২৫ জানুয়ারি, ২০১৭ , সিরাজুল ইসলাম লেকচার হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইংরেজ শাসন চালু হওয়ার পর বাংলার বহুকালের সংস্কারাচ্ছন্ন ও মধ্যযুগীয় নিস্তরঙ্গ জীবনে কালান্তরের সূচনা ঘটে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন, ইউরোপীয় ও আমেরিকান ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বানিজ্যের সুযোগ, আধুনিক শিক্ষার সূচনা, কলকাতা নগরের বিকাশ ইত্যাদির ফলে সামাজিক মূল্যবোধেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। বর্ণব্যবস্থা ও ভূমির বদলে সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও কৌলিন্যের মাপকাঠি হয়ে উঠে বিদ্যা ও বিত্ত। এই বিদ্যা ও বিত্তের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠলো এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি- যার একদিকে ছিল বিত্তবান ‘বাবু’ শ্রেণি, অন্যদিকে ছিল ইংরেজি-জানা ‘ভদ্রলোক’ শ্রেণি।
নতুন এই মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু এবং তাঁদের প্রায় সকলেরই বাস ছিল কলকাতার অদূরে (হাঁটা পথের মধ্যে)। উপার্জনহীন কুলীন ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যরাও জীবিকার প্রয়োজনে এগিয়ে এলেন ইংরেজি শিক্ষা ও বৈশ্যবৃত্তির পথে। কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ মানুষ, কিংবা মুসলমান যারা ছিলেন চাষাবাদ কিংবা অন্য কোন স্বাধীন বৃত্তিধারী, শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তেমন অনুভব করলেন না। তাছাড়া, তখনো গ্রামে-গ্রামে ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি এবং ইংরেজি শিক্ষা, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত, ছিল রীতিমতো ব্যায়বহুল।
উনিশ শতকে মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। ফলে জমির উপর তেমন কোন চাপ না পড়ায় জমির উপর নির্ভরশীল লোকেরা জমির আয়কে নিরাপদ এবং হয়ত যথেষ্ট বলে মনে করতেন। বঙ্গদেশে এই জমির উপর নির্ভরশীল চাষির সংখ্যা হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মধ্যে ছিল অধিক। ১৯১১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী শতকরা ৮৬ জন মুসলমানই ছিলেন জমির উপর নির্ভরশীল। মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গে এ-হার স্বভাবতই বেশি ছিলো। জীবন-রক্ষাকারী ঔষধের আবিষ্কার ও অন্যান্য কারণে ধীরে ধীরে মৃত্যুর হার কমে যাওয়ায় জমির উপর চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও মুসলমানরা ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কিন্তু লেখাপড়ার সুযোগ নিতে পারলেন শুধু জমি থেকে যাদের আয় অন্তত মধ্যমশ্রেণির তাঁরাই। ভূমিহীনরা বঞ্চিত হলেন শিক্ষার আলোক থেকে। এভাবে মুসলমানরা তাঁদের প্রতিবেশি বর্ণ হিন্দুদের তুলনায় ইংরেজি তথা পাশ্চাত্য শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে গেলেন।
ইংরেজি শিক্ষার এই অসমান বিকাশের ফলে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চাকুরি, পেশাগত বৃত্তি, ব্যবসা-বানিজ্য ও শিল্পে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এক ব্যাপক বৈষম্যের প্রকাশ ঘটে। ইংরেজ-প্রবর্তিত নিপীড়নমূলক ভূমিব্যবস্থায় জমিদার-রায়তের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ঐতিহাসিক কারণে ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িক সচেতনায় রূপান্তরিত হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নবউত্থিত জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রুখে দেয়া এবং ‘ভদ্রলোক’ রাজনীতিকদের ক্ষমতা খর্ব করার লক্ষ্যে মুসলমানদের এই ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতাবাদের ঘৃতে আগুন ঢালে ঔপনিবেশিক শাসক। বঙ্গভঙ্গ হয়। মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে স্থানগত দিক থেকে পূর্ববঙ্গ ও সম্প্রদায় হিসেবে মুসলমানরা কিছুটা উপকৃত হয়। ফলে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে তাঁরা এই বর্ধিত সুযোগ-সুবিধা হারান এবং হিন্দুদের দায়ী করেন।
১৯০৫ সাল থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে বঙ্গদেশের রাজনীতিতে এই হিন্দু-মুসলিম স্বার্থই প্রধান হয়ে উঠে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বাঙালি মুসলমানগণ বর্ধিত সুযোগ সুবিধা পান শিক্ষা, চাকুরি, ব্যবসা ও শিল্পের ক্ষেত্রে। বর্ধিত অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধা পেয়ে অল্পকালের মধ্যে এ যাবত অজ্ঞাত একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠে। হিন্দু ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র শিল্পের মালিকগণ দেশ ত্যাগের ফলে সেই স্থান দখল করেন অনভিজ্ঞ ও স্বল্প বিত্তের বাঙালি মুসলমান। এভাবে পূর্ববঙ্গে দ্রুত একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পটভূমিতেই পূর্ববঙ্গে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ও লালন ঘটে, উত্থান ঘটে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের। সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে প্রাধান্য বিস্তারের আশায় পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভোর হয়েছিল বাঙালি মুসলমান, তা ভঙ্গ হতে দেরি হয় না। ফলে পাকিস্তানের সেমি-ঔপনিবেশিক ও শোষণমূলক মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে গড়ে উঠে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করে নবসৃষ্ট মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
বাংলাদেশ আমলে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আকার বেড়েছে অভূতপূর্ব হারে। কিন্তু তার সাথে সাথে মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে ভয়াবহভাবে। এমন অপরাধ এখন ঘটছে, যা এককালে ছিল অকল্পনীয়। তবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে নারীদের বিকাশের অসাধারণ সুযোগ ঘটেছে। গার্মেন্টস শিল্পে নারী শ্রমিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ও অবদানের সুযোগ তৈরি হয়েছে শুধুমাত্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে। স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি মুসলমানের মুক্তি ঘটেছে বটে, বাংলাদেশ কিংবা পশ্চিমবঙ্গে নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের মুক্তি ঘটেনি কোথাও। একটা ‘শুদ্রস্থান’ প্রতিষ্ঠা করা গেলে হয়ত তাদের মুক্তির পথ তৈরি হত!