উনিশ শতকে বাঙালির গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৫ বছর। এ থেকেই বোঝা যাই বাঙালির স্বাস্থ্য কতোটা রুগ্ন ছিল।কিন্তু কেন বাঙালির স্বাস্থ্য এতটা রুগ্ন ছিল? আসলে জাতিগত ভাবেই বাঙালির স্বাস্থ্য খুবই দুর্বল। তার উপর কোম্পানির অপশাসনের ফলে ১৭৭০ সালে বাংলায় এক ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ নেমে আসে। ফলে মোট জনগণের তিন ভাগের এক ভাগ প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যাই। বেশির ভাগ গ্রাম জঙ্গলে পরিণত হয়। মশার ওতপাত ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে নদীপূর্ণ হয়ে যায়। ফলে পানিবাহিত রোগ জীবাণু দেখা যায়। স্বাস্থ্যসম্মত সেনিট্রেশন না থাকার কারণে পানি বাহিত রোগের আক্রমণ আরও বেড়ে যাই। তাছাড়া কলেরা, ম্যালেরিয়া, বসন্ত, টাইফয়েড, যক্ষ্মা, রক্ত আমাশয়, উদারাময়, বাতরোগ, কালাজ্বর, ডোবা, অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির কারণে গ্রামের পর গ্রাম মানুষ মরে সাফ হয়ে যাই। আর সেই সময় মানুষ কবিরাজ-ওঝাদের কাছ থেকে চিকিৎসা সেবা নিতো। ফলে এই সকল রোগ জীবাণু, পুষ্টিহীনতা ও সনাতনী চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণেই বাঙালির উনিশ শতকে গড় আয়ু ছিল মাত্র ২৫ বছর।
উনিশ শতকে বাঙালির গড় আয়ু ছিল পঁচিশ বছর তা আগেই বলেছি। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭১ বছর। গত দুই শত বছরে বাঙালির স্বাস্থ্যের এমন উন্নতির একটি বড় কারণ আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা। যে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা এমন মানব কল্যাণ বয়ে আনলো, সে চিকিসা ব্যবস্থার যাত্রা কবে থেকে শুরু হল? কারা যাত্রা শুরু করলো? এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোন গবেষণা হয়নি। এই প্রবন্ধে কিভাবে আমরা আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা পেলাম তার ইতিহাস খুজে বের করার চেষ্টা করবো।
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা:
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানি তার ব্যয় কমানোর জন্য মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। কারণ ইংল্যান্ড থেকে ডাক্তার নিয়ে আসতে কোম্পানির বেশি ব্যয় করতে হয়। এদেশীয়দের চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠ করালে কম খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়া যাবে। তাছাড়া মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করার জন্য কলকাতা কেন্দ্রিক জমিদার শ্রেণি অর্থনৈতিক সহযোগিতা দেওয়ার প্রস্তাব দেই। ফলে কোম্পানির জন্য কাজটা বেশ সহজ হয়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসেন যে কয়েকজন জমিদার তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। যদিও চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠ করা সহজ ছিল না। ধর্মীয় কুসংস্কার ছিল। সামাজিক বাধা নিষেধ ছিল। শব ব্যবচ্ছেদ করার বিপক্ষে ছিল বাংলার সমাজ ব্যবস্থা। আর শব ব্যবচ্ছেদ না করা গেলে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র ভালভাবে শেখাও সম্ভব নয়। ফলে সমাজের প্রতিকূলে যেয়ে ১৮৩৬ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় ছাত্রেরা শব ব্যবচ্ছেদ করে। মধুসূদন গুপ্ত প্রথম ভারতীয় যিনি মানব দেহের শব ব্যবচ্ছেদ করেন। তার ছাত্র হিসেবে উমাচরণ শেট, রাজকৃষ্ণ দে, দ্বারকানাথ গুপ্ত ও নবীনচন্দ্র মিত্র সর্ব প্রথম শব ব্যবচ্ছেদে অংশ গ্রহণ করেন। কলকাতার গোড়া হিন্দুরা শব ব্যবচ্ছেদেও বিপক্ষে আন্দোলন করেন। এই সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নেন মধুসূদন গুপ্ত ও তার ছাত্ররা।
দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামকমল সেন প্রমুখের মতো স্বনামধন্য ব্যক্তিরা কৃতী ছাত্রদের জন্য বৃত্তি ও পুরস্কারের ব্যবস্থা করে সি.এম.সি-তে চিকিৎসা শিক্ষাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রফেসর গুডইভ ও আংশিকভাবে ব্রিটিশ সরকার কলেজের চারজন ছাত্রকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে প্রথমবারের মতো বিলেতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। তবে বিলেতে যাওয়া সহজ ছিল না বিশেষ করে হিন্দুদের। কারণ হিন্দু সমাজে কুসংস্কার ছিল কালাপানি পাড়ি দিলে জাত চলে যাই। এসকল প্রবন্ধকতাকে উৎরিয়ে তারা আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠের জন্য বিলেতে যান। সে দিন সমাজ তাদের মেনে নেইনি। কিন্তু তারা সেদিন বিলেত না গেলে আজকের চিকিৎসা ব্যবস্থা কতটুকু আধুনিক হতো তা বলা শক্ত। এরা প্রত্যেকেই ছিল ভীষণ মেধাবী। তারা দেশে ফিরে চিকিৎসা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাদের হাত ধরেই মূলত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার যাত্রা বাংলায় শুরু হয়। যদিও তাদের আমরা অনেকটা ভুলতে বসেছি।
১৮৫৮ সালে মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা:
কোম্পানি আমলে (১৭৫৭-১৮৫৭) কলকাতা ছিল বাংলা তথা ভারতের রাজধানী। সেখানে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ছিলেন। একটি নতুন গড়ে ওঠা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাস ছিল কলকাতায়। ফলে কলকাতায় ১৮৩৫ সালে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়া খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ঢাকায়? ঢাকা তো তত দিনে জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। ১৭০৪ সালে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হলে ঢাকার ব্যবসা বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে যাই, ঢাকা একেবারে রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। যদিও পূর্ববঙ্গের আশা-ভরসার প্রতীক ছিল ঢাকা। পূর্ব বঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক মাত্র ভরসা ছিল ঢাকা। তবে ঢাকায় কলকাতার মতো একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাস ছিল না। ফলে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ঢাকাতেও একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না। তবুও ১৮৫৮ সালে ঢাকায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। তাও আবার কোন বাঙালির নামে নয়, একজন ইংরেজের নামে। মিটফোর্ড হাসপাতাল। কে এই মিটফোর্ড?
রবার্ট মিটফোর্ড ইংল্যান্ডের অভিজাত মিটফোর্ড পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৭৮২ সালে। ১৭৯৮ সালে তিনি কোম্পানির রাইটার পদে চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন। দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে ঢাকা জেলার কালেক্টর হন। পরে বিচারকও হন। তিনি ১৮১৬ সাল থেকে ১৮২৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ঢাকায় অবস্থান করেন। এই সময়ে ঢাকার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক দুরাবস্থা এবং ভয়াবহ রোগ জীবাণু দেখে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। ১৮২৮ সালে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এর পরেও তিনি আরও আট বছর বেঁচেছিলেন। ১৮৩৬ সালে পারিবারিক ও মানসিক বেদনাদায়ক অবস্থায় থেকে মারা যান। মারা যাওয়ার সময় তিনি তার স¤পত্তির বিশাল অংশ ঢাকায় দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা জনকল্যাণমূলক কাজের জন্য Government of Bengal কে প্রদান করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড ডালহৌসি। তিনি এই ফান্ডের টাকায় ঢাকায় একটি মেডিক্যাল হাসপাতাল স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এই ধারাবাহিকটায় ১৮৫৮ সালে মিডফোর্ড-এর নাম অনুসারে মিডফোর্ড হাসপাতাল-এর পথ চলা শুরু হয়।
অচিরেই এটি পূর্ববাংলার সকল মানুষের প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে। বসন্ত রোগের প্রতিরোধের জন্য হাসপাতালটি প্রথম থেকেই ঢাকাবাসীকে টিকা দিয়ে আসছে। ১৮৭০ সালে টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করে হাসপাতালটি। ফলে অনেক মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বেচে যাই। সন্তান প্রসবের সময় হাসপাতালটি ঔষধপত্র ও বিছানাপত্র পর্যন্ত প্রদান করে। দাইদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করতো। কারণ সামাজিক কুসংস্কারের কারণে মহিলারা সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে আসতেন না। ফলে শিশু মৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। তাই মহিলারা যাতে হাসপাতালে আসে তাই হাসপাতালটি কয়েকটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। যেমন বিনামূল্যে ঔষধ প্রদান করে, অল্প কিছু অর্থনৈতিক সহযোগিতা করে মহিলাদের হাসপাতাল মুখী হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে। এভাবে পূর্ব বঙ্গে প্রথমবারের মতো কবিরাজি ব্যবস্থা থেকে ডাক্তারি ব্যবস্থার প্রচলন হয়।
হাসপাতালটিকে স¤প্রসারিত করার জন্য পূর্ব বঙ্গের বেশ কয়েকজন জমিদার অর্থ দান করে। যেমনটা কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠায় কলকাতার জমিদাররা করেছিলেন। তারা হলেন ভাওয়ালের রাজা রায় কালী নারায়ণ রায় চৌধুরী বাহাদুর, খাজা আহসানুল্লাহ, রাজা শ্রী রায় ও কয়েকজন ইউরোপীয় সদস্য উল্লেখযোগ্য। কিন্তু কলকাতার ওই সকল জমিদারের ভূমিকা সুধী সমাজে মূল্যায়ন হলেও, পূর্ব বঙ্গের জমিদারদের ভূমিকা এখনো সামাজিক ইতিহাসে স্থান পাইনি।
১৮৭৫ সালে ঢাকা মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠা:
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও পূর্ব বঙ্গে চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠের কোন কেন্দ্র ছিল না। প্রথম বারের মতো ১৮৬৩ সালে ঢাকা প্রকাশ পূর্ব বাংলায় একটি মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে। এই সময় কলকাতা মেডিকেল কলেজেও ছাত্র ভর্তির উপর বেশ চাপ পড়ে। এই চাপকে সামাল দেওয়ার জন্য তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জর্জ ক্যা¤পবেল কয়েকটি মেডিকেল স্কুল করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই ধারাবাহিকটায় ১৮৭৫ সালে ঢাকা মেডিকেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গ সাদরে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গ্রহণ করে নেই। ভর্তি হত্তয়া ছাত্রদের বেশির ভাগই ছিল গরিব কিন্তু তারা মেধাবী ছিল। এই গরিব মেধাবী ছাত্ররাই পূর্ববঙ্গে শুরু করে আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চা। ছাত্রদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য সরকার স্কলারশীপের ব্যবস্থা করে। মেডিকেল স্কুলকে সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য প্রাণপণ প্রচেষ্টা করেন ডি বি স্মিথ। পালন করেন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব। কিন্তু আমরা স্মিথকে ভুলেই গেছি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা এক গুরুদায়িত্ব পালন করে। গ্রামের গরিব মানুষদের কাছে তারাই প্রথম আধুনিক চিকিৎসা সেবা পৌছে দেই। বেশির ভাগ মানুষই গ্রামে বাস করতো। তারা চিকিৎসা সেবা নিতো গ্রামের কবিরাজদের কাছ থেকে। ফলে রোগ জীবাণু থেকে তাদের মুক্তির কোন পথ ছিল না। কলকাতা মেডিকেল কলেজে যারা পড়ত তারা কেউ গ্রামে যেতেন না। কারণ তারা ছিল উচ্চ শিক্ষিত ডাক্তার। গ্রামে তাদের পোষাত না। গ্রামে যেয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করার মতো তাদের মানসিকতাও ছিল না। তাই এক মাত্র ভরসা ছিল ঢাকা মেডিকেল স্কুল থেকে পাশ করা মাঝারি মানের ডাক্তারদের ওপরে। এ সকল ডাক্তাররা গ্রামে যেয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করলে কবিরাজি চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সেখানে স্থান করে নেই আধুনিক চিকিৎসা সেবা। ১৮৮০ সালে এই স্কুল থেকে ফাইনাল পরীক্ষায় পাস করে ২২জন ছাত্র। এরাই মূলত পূর্ববঙ্গে আধুনিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে সাধারণ মানুষের দোর প্রান্তরে পৌঁছায়। ইতিহাসে এরায় এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে।
চিকিৎসাশাস্ত্র গ্রহণে নারীদের অংশগ্রহণ:
১৮৩৫ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও নারীদের চিকিৎসা শিক্ষার তখনও সুযোগ খুলে যাইনি। যদিও নারী ডাক্তারদের খুবই প্রয়োজন ছিল। কারণ জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল নারী। তাছাড়া পর্দাপথার ফলে পুরুষ ডাক্তার দিয়ে নারীদের চিকিৎসা ছিল অকল্পনীয় বিষয়। তাদের সাধারণ অসুখ-বিসুখ ছাড়াও সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় নারীরা দারুণ বিপদের মুখে পড়তো হতো। এরা পুরুষ ডাক্তারের কাছ থেকে সেবা নেওয়ার চেয়ে মৃত্যুকে শ্রেয় বলে মনে করত। বাংলায় নারী ডাক্তারের অভাব গভীরভাবে অনুভব করলেন স্যার আলফ্রেড ডব্লিউ. ক্রাফট। তিনি ছিলেন বাংলার ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন। ১৮৮২ সালে তিনি কলকাতা কলেজের প্রিন্সিপালের আছে চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি এল এম এস ক্লাসে মেয়েদের পড়াশুনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। এই চিঠির মাধ্যমেই একটি আলোচনার সূত্রপাত হয়। অনেকেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। এই ঘটনা তৎকালীন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিভার্স টমসন (১৮৮২-১৮৮৭) এর কানে যাই। তিনি ইতিবাচকভাবে এটি গ্রহণ করেন। এর ফলেই কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রী ভর্তি হওয়ার সুযোগ খুলে যাই। তিনি ১৮৮৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রী ভর্তির অনুমতি প্রদান করেন। ১৮৮৪ সালে দুইজন ছাত্রী কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হন। সেই দুই সাহসী নারী হলেন শ্রীমতী বিধুমুখী বসু এবং কুমারী ভার্জিনিয়া মেরী মিত্র। পরে তাদের দেখাদেখি অনেক নারীই মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়।
১৮৮৩ সালে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ছাত্রী ভর্তির সুযোগ চালু হলেও কলকাতা ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল ও ঢাকা মেডিকেল স্কুলে ততদিনেও চালু হয়নি। এ ক্ষেত্রেও এগিয়ে আসেন স্যার আলফ্রেড ক্রফট। ১৮৮৭ সালে স্যার আলফ্রেড ক্রফট সরকারের কাছে প্রস্তাব দেন। যাতে করে কলকাতা ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুল ও ঢাকা মেডিক্যাল স্কুলে ছেলেদের মত মেয়েদেরও পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নারীদের চিকিৎসা শাস্ত্র গ্রহণ করাটা মোটেও সহজ ছিল না। স্যার আলফ্রেড ক্রফট এই কঠিন সত্যটা উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি নারীদের বাড়তি সুযোগ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেন।
কিন্তু ইন্সপেক্টর জেনারেল অব সিভিল হসপিটালস ডাক্তার এ জে কাউই ক্রাফটের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কারণ হিসেবে বলেন, কলকাতার কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের ১৬ বছর বয়সী মেয়ে এই রকম প্রশিক্ষণ নেবে না। তাছাড়া মেয়েদের শিক্ষার মান খুবই নিচু। ব্রাহ্মরাও তাদের মেয়েদের চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠ করতে দিবেন না। তাছাড়া সাতজন ডাক্তার সিভিল সার্জন আরও অভিযোগ করেন যে, সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবে না। যদিও গ্রহণ করে চাকরি করবে না। যদি তারা করেও ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে।
এই বিতর্ক লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার স্টুয়াট চার্লস বেইলির মনে গভীর দাগ কাটে। তিনি এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য উপলব্ধি করেন। সরকারের পক্ষে যে কিছু করা জরুরী তা অনুমান করেন। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে প্রস্তাবটি পরীক্ষা করে দেখার উপযুক্ত। তিনি বলেন, it is worthwhile trying the experiment. if the candidates do not come or coming fail to get diplomas, it will be easy to withdraw from it. এই ধারনার আলোকেই তিনি ১৮৮৭ সালে ক্রাফটের প্রস্তাবটি অনুমোদন করেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় স্যার বেইলির সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি। ১৮৯৪ সালে পরীক্ষার মাধ্যমে বাছাই করে ৬ ছাত্রীকে ভর্তি করা হয়। তারা ছিল পড়াশুনায় খুব মনোযোগি, উৎসাহী, আগ্রহী। ফলে তারা যে নিম্নমানের শিক্ষা নিয়ে আসলেও অল্প দিনেই তা তারা কাটিয়ে ওঠে। এভাবে পূর্ব বঙ্গের মেয়েরা চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠ করা শুরু করে। আর এই উদ্যোগ যিনি গ্রহণ করেন তিনি স্যার আলফ্রেড ক্রফট। অথচ আমরা এখনো তার অবদানের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারিনি।
এভাবে বাংলায় চিকিৎসা ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। ধীরে ধীরে মানুষ বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পেতে থাকে। ফলেমানুষের গড় আয়ু বাড়তে থাকে। কবিরাজি ব্যবস্থা আসতে আসতে বিলীন হয়ে যাই। স্থান করে নেই আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা। অথচ যারা এই ব্যবস্থা নিয়ে আনলেন তাদের অবদান আমরা এখনো সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি। হয়নি তাদের নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা।
তথ্যসূত্র:
১। শরীফ উদ্দিন আহমদ, মিটফোর্ড হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল স্কুলঃ ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ২০০৭
২। গোলাম মুরশিদ, কালাপানির হাত ছানি বিলেতে বাঙালির ইতিহাস
৩। কিশোরীলাল মিত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুর
৪। মুনতাসীর মামুন, উনিশ শতকের বাংলাদেশের সংবাদ সাময়িক পত্র, ৫ম খণ্ড, ৬ষ্ট খণ্ড, ৯ম খণ্ড
৫। মুনতাসীর মামুন, সিভিলিয়ানদের চোখে ঢাকা
৬। মুনতাসীর মামুন, উনিশ শতকের পূর্ববঙ্গের সমাজ (১৮৫৭-১৯০৫)
৭। জেমস টেলর, কোম্পানি আমলে ঢাকা
৮। বিনয় ঘোষ, বাংলার বিদ্বৎসমাজ
৯। বিনয় ঘোষ, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত
১০। বিনয় ঘোষ, সুতানুতি সমাচার
১১। আহমদ রফিক, স্মৃতি বিস্মৃতির ঢাকা মেডিকেল কলেজ (১৯৪৭-১৯৭১)
১২। convocation speeches, Dhaka university, sirajul islam choudhury first part.
১৩। দ্বারকানাথের জীবনী, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর