১৯৪৭ সালের দেশভাগ (বাংলা ভাগ) নিয়ে অ্যাকাডেমিক আলোচনা কিংবা শিল্প-সাহিত্যে তার প্রতিফলন প্রধানত পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক। কারণ, যে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় উপমহাদেশে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম এবং যে প্রক্রিয়ায় বাংলা বিভাজিত হয়েছিল, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে অভিবাসী হতে বাধ্য হওয়া বাঙালিদের জন্য তা ছিল রাজনৈতিক গন্তব্যের শেষ পেরেক। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হতে গিয়ে তাদের পিতৃভূমি থেকে উৎপাটিত হতে হয়েছে, সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের কাছে নিজেদের বাঙালি জাতীয়তাবোধকে বিসর্জন দিতে হয়েছে এবং পূর্ববঙ্গের স্বতন্ত্র গ্রামীন সংস্কৃতি থেকে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষত কলকাতার নাগরিক সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে, সমাজ-রাষ্ট্রে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করার জন্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হয়েছে এবং ফলে তাদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটের সাথে নানারকম বোঝাপড়া হলেও তা থেকে চুড়ান্ত উত্তরণ ঘটেনি, তার প্রমাণ হলো পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যে কিংবা চলচ্চিত্রে এখনো দেশভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে অভিবাসী হয়ে পূর্ববঙ্গে আসা বাঙালি মুসলমানদের জন্য দেশভাগ ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়েছে। তুলনামূলক অবিকশিত সমাজে এসে তারা সহজেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছেন। কিন্তু দেশভাগের ক্ষত ভুলতে তাদের জন্য প্রধান ঔষধি হিসেবে কাজ করেছে- পূর্ববঙ্গে বাঙালির স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তা বিকাশের অমিত সম্ভাবনা নিয়ে আসা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অগ্রগামী গোষ্ঠী হিসেবে সেই আন্দোলনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ফলে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এখন তাদের জন্য দূরবর্তী ও স্মৃতিতে ধুসর ঐতিহাসিক ঘটনা মাত্র। ফলে, স্বতন্ত্র ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে দেশভাগ নিয়ে আলোচনা-গবেষণা বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভ্যূদয়ের ইতিহাসে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে দেশভাগ। কিন্তু এর সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোন অ্যাকাডেমিক আলোচনা নেই। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি নির্মাণে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। এই বিবেচনা থেকেই আজকের লেকচারের আয়োজন।
সুদীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের অধিকারী কোন গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় যাদের পরিচয় ও প্রতিষ্ঠার প্রধান উৎস ঐতিহ্যিকভাবে আয়ত্ব বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রেষ্ঠত্ব, সাধারণত তাদেরকে বোঝাতে “বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাত” শব্দগুচ্ছ ব্যবহৃত হয়। উপমহাদেশের প্রেক্ষাপটে হিন্দু বর্ণপ্রথার সর্বোচ্চ স্তর ব্রাহ্মণদের “বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাত” হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তবে বিদ্যা অর্জন ও বন্টনব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের বহু শতাব্দীর একচ্ছত্র আধিপত্য ব্রিটিশ শাসনামলে পরিবর্তিত রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে এসে হাতছাড়া হয়ে যায়। রামমোহন রায় (১৭৭৩-১৮৩৩) প্রবর্তিত ব্রাহ্মধর্ম প্রথম সেই আধিপত্যে আঘাত হানে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাত হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। উনিশ শতকের শেষদিকে ব্রাহ্মধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা নিঃশেষিত হয় এবং তা হিন্দুধর্মের একটি শাখা হিসেবে অবলুপ্ত হয়। ব্রাহ্মধর্মের ভূমিকা ঐতিহ্য-সংশ্লিষ্ট ছিল, বিযুক্ত নয়। কিন্তু ঔপনিবেশিক সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রব্যবস্থায়
ঐতিহ্যিক পেশা ও কুলবৃত্তির ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং উনিশ শতকের প্রথমার্ধে স্বল্পশিক্ষিত বাণিজ্যনির্ভর ‘বাবু’ শ্রেণি এবং দ্বিতীয়ার্ধে প্রধানত শিক্ষা-নির্ভর, ‘ভদ্রলোক’ নামে বিশেষায়িত ও ঐতিহ্যবিযুক্ত এক নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠে, যাদেরকে বৃহত্তর অর্থে নতুন ‘বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজাত‘ শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই নতুন শিক্ষিত অভিজাত শ্রেণিতে পশ্চাৎপদ মুমলমান সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ছিল নগণ্য এবং প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের অবাঙালি ও অভিবাসী মুসলিম অভিজাতরাই আধুনিক শিক্ষার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাদের পারিবারিক আভিজাত্যের সাথে যুক্ত হয়েছিলো নবলব্ধ বিদ্যার আভিজাত্য, বঙ্গের সোহরাওয়ার্দী পরিবার যার যথার্থ উদাহারণ। ঐতিহ্যবিযুক্ত ও আধুনিক শিক্ষা-নির্ভর মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ হয়েছিলো বিলম্বিত এবং তাও কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কারণ, প্রথম পর্বের শিক্ষিত বাঙালি মুসলমান মানেই ছিলো কলকাতায় শিক্ষিত কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাঙালি মুসলমান।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিলো বঙ্গেদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজধানী, ঔপনিবেশিক কাঠামোর কারণে যা ছিল অতি কেন্দ্রীভূত (over-centralised)। পশ্চাদভূমি পূর্ববঙ্গে উনিশ শতকের নবজাগরণের উদ্দীপনা পৌঁছেছিল প্রধানত ব্রাহ্ম আন্দোলনের পথ ধরে, তাও হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ছিল সীমাবদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিম্নবর্গের মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য আধুনিক শিক্ষার সুযোগই ছিল অপ্রতুল। অভিজাত মুসলমানদের আবাসভূমিও ছিল না পূর্ববঙ্গ। সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে পশ্চাৎপদ একটা অঞ্চলে বুদ্ধিবৃত্তিক সমৃদ্ধির শর্ত তৈরি হতে পারেনি। ফলে, ৪৭-পূর্ববর্তী পূর্ববঙ্গে কোন ধারাবাহিক বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তৈরি হয়নি। এর একটা প্রমাণ ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ বা ‘শিখাগোষ্ঠী’, পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো যার মাধ্যমে, প্রতিষ্ঠার এক দশকের মধ্যেই তার অকালমৃত্যু ঘটেছিলো। শুধু তাই নয়; আন্দোলনের প্রবক্তাগণ ষোল শতকের গ্যালিলিওর মতো নিগ্রহের শিকার হয়ে, মুচলেকা দিয়ে পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এই একই পশ্চাৎভূমিতে দেশভাগের পাঁচ বছরের মধ্যেই ভাষা আন্দোলনের মতো অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল আন্দোলন কীভাবে সম্ভাবিত হয়েছিলো? এই আন্দোলন ও পরবর্তী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও উদারনৈতিক চিন্তাভিত্তি কীভাবে তৈরি হয়েছিলো? শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকার উপর অতি-গুরুত্বারোপ করে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কারণ, ১৯৪৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১৫০০ প্রায়, যার অধিকাংশ ছিলো হিন্দু। দেশভাগের ফলে হিন্দু শিক্ষকদের ভারতে চলে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট সংকট এবং নতুন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর অত্যাধিক চাপের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে কানা হয়ে গিয়েছিলো। এই প্রেক্ষিতেই আসে পশ্চিমবঙ্গ কিংবা ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে পূর্ববঙ্গে অভিবাসী হয়ে আসা বাঙালি মুসলমানদের প্রসঙ্গ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ববঙ্গের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে তাদের কী বিশেষ কোন ভূমিকা ছিলো? যদি থাকে, তবে সেই ভূমিকার বিশ্লেষণ থেকে কি
আমাদের উপরোক্ত প্রশ্নের জবাব পাওয়া যাবে? এই লেকচারে এসব প্রশ্নের উত্তর, বিশেষত ১৯৪৭ সালের বাংলা ভাগের অভিঘাতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সামগ্রিক চিন্তাকাঠামোতে কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তার অনুসন্ধান করা হবে।