মাহমুদুল ইসলাম: সংবিধানে সমাধিস্থ জীবন
no data found
অক্টোবর ১০, ২০২১

গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রভিত্তি নির্মাণে যে সকল মহৎ ব্যক্তিত্ব অলক্ষ্যে কান্ডারির ভূমিকা পালন করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে মাহমুদুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। তিনি শুধু একজন আইনজীবী ছিলেন না, ছিলেন একজন মহান আইনজ্ঞ। স্বাধীন আইনজীবী, অ্যাটর্নি জেনারেল কিংবা অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে গত পাঁচ দশকের বাংলাদেশের প্রায় সব যুগান্তকারী সাংবিধানিক মামলার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভাষ্য ক্সতরি করে দেশে সাংবিধানিক আইন ও সাংবিধানিকতা বিকাশে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাজীবনে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠা, আইনি প্রজ্ঞা, দেশ ও জনগণের প্রতি অকুণ্ঠ নিবেদন, গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের পক্ষে অনমনীয় অবস্থান গ্রহণের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনের আইনব্যক্তিত্ব, বিচার বিভাগের প্রতি জনআস্থার প্রতীক।    

১৯৩৬ সালের ২৪ জুলাই রংপুরের এক আইনজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মাহমুদুল ইসলাম। তাঁর পিতা রংপুরের বিখ্যাত আইনজীবী খান সাহেব আজিজুল ইসলাম ও মাতা জাহানারা ইসলাম। মাহমুদুল ইসলামের প্রপিতামহ মো. আশরাফ উদ্দিন ও মামা আজিজুল হক রংপুর বারের খ্যাতনামা আইনজীবী ছিলেন। তাঁর স্কুল ও কলেজ জীবন রংপুরে অতিবাহিত হয়। মাহমুদুল ইসলামের পেশা নির্বাচনে বৃহত্তর পারিবারিক পরিন্ডল প্রভাব ফেলেছিল।  

মাহমুদুল ইসলাম ১৯৫১ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে তিনি বি.এ. পাস করেন। ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ¦ি বদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ এবং ১৯৫৯ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এলএলবি ডিগ্রি র্অজন করেন। আইনপেশায় প্রতিষ্ঠা অর্জনের বেশ কিছুকাল পরে ১৯৭৯ সালে তিনি বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর অধ্যয়ন করে আইনে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এই কোর্সে তাঁর থিসিসের বিষয় ছিল Estoppels against Government

১৯৫৯ সালে তিনি শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে রংপুর বারে যোগদান করেন। ১৯৬১ সনের জুন মাসে মাহমুদুল ইসলাম আইনজীবী হিসেবে সনদ র্অজন করেন এবং রংপুর জেলা জজ আদালতে আইন প্র্যাকটিস শুরু করেন। তাঁর আইনজীবী পিতা খান সাহেব আজিজুল ইসলামও সেখানে প্র্যাকটিস করতেন। পিতার পরিচিতির সুবাধে রংপুর বারের প্রবীণ আইনজীবী বিজয় চন্দ ্র ক্সমত্র, শীতল রায় চৌধুরী, শীবেন্দন্র াথ মুখোপাধ্যায়ের জুনিয়র হিসেবে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন মাহমুদুল ইসলাম। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে তিনি তৎকালীন ঢাকা হাইর্কোটের সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি আপীল বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি সিনিয়র অ্যাডভোকেটের সম্মানে ভূষিত হন এবং আমৃত্যু আইনপেশায় নিয়োজিত ছিলেন।  

দীর্ঘ পাঁচ দশকের আইনজীবী ক্যারিয়ারে মাহমুদুল ইসলাম অনেক মামলা পরিচালনা করেছেন। তাঁর পরিচালিত অনেক মামলার রায়ে সুপ্রীম কোর্ট আইনের নতুন নীতি নির্ধারণ করেছে। এ ধরনের কয়েকটি মামলা হলো- ড. নুরুল ইসলাম বনাম বাংলাদেশ (৩৩ ডিএলআর ১৯৮১ এডি ২০১); শার্পিং মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি বনাম বাংলাদেশ (৩৯ ডিএলআর ১৯৮৭ এডি ৮৫); আনোয়ার হোসেন চেীধুরী বনাম বাংলাদেশ (৪১ ডিএলআর ১৯৮৯ এডি ১৬৫); সংবিধান ৭ম সংশোধনী মামলা (৬৫ ডিএলআর ২০১৩ এডি ৮); আব্দুল মান্নান খান বনাম বাংলাদেশ (৬৪ ডিএলআর ২০১২ এডি ১৬৯, সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলা); কমিশনার অব কাস্টমস বনাম গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী (৫০ ডিএলআর ১৯৯৮ এডি ১২৯) মোস্তফা কামাল নামীয় .. .   ..  .. । 

মাহমুদুল ইসলাম ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সহকারি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিল থেকে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক স্পেশাল প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যারিস্টার ইশতিয়াকের সাথে পরিচয়ের মাধ্যমে মাহমুদুল ইসলামের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বাঁক-বদল ঘটে। তিনি পরবর্তীতে ইশতিয়াকের চেম্বারে যোগ দিয়ে একসঙ্গে অনেক বিখ্যাত সাংবিধানিক মামলা পরিচালনা করেন।  প্রজ্ঞাবান ও ন্যায়নিষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতিস্বরুপ মাহমুদুল ইসলাম ১৯৯৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ আইন-কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৯৮ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের উদ্যোগে প্রকাশিত বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিশনস (বিএলডি)-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুল ইসলাম।  

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের গাইডলাইন হিসেবে ১৯৭২ সালে প্রণীত ও গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। কিন্তু দীর্ঘ সামরিক শাসনের কারণে দেশে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি সংবিধানের ব্যাখ্যা-ভাষ্য ক্সতরিতেও তখন কোন আইনজ্ঞ এগিয়ে আসেননি। সংবিধান ও সাংবিধানিক আইন চর্চা ও 

গবেষণায় আমাদের এই খরা-দশা গুচাতে এগিয়ে আসেন মাহমুদুল ইসলাম। অষ্টম সংশোধনী মামলা পরিচালনার সময় থেকে তিনি বাংলাদেশের সংবিধানের একটি কম্প্রিহেন্সিভ কমেন্টারি প্রণয়নের পরিকল্পনা তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এরই ফলশ্রæতিতে সংবিধান প্রণয়নের দীর্ঘ ২৩ বছর পর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় বাংলাদেশের সংবিধানের উপর প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তৃত কমেন্টারি Constitutional Law of Bangladesh তাঁর জীবদ্দশাতেই এই গ্রন্থ ক্ল্যাসিক হিসেবে মর্যাদা লাভ করে এবং মাহমুদুল ইসলাম সাংবিধানিক আইনজ্ঞ হিসেবে ব্ল্যাকস্টোন, হোমস, দূর্গাদাস বসুর কাতারে শামিল হন।       

ব্যক্তিজীবনে মাহমুদুল ইসলাম ছিলেন মৃদুভাষী, সদালাপী ও অন্তর্মুখী ব্যক্তিত্ব। শেষজীবনে মাহমুদুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ৭৯ বছর বয়সে মাহমুদুল ইসলাম ইহকাল ত্যাগ করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে মাহমুদুল ইসলামের স্মরণে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞ বিচারপতি আব্দুল মতিন একটি চমৎকার প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশে আইনের শাসন সুদৃঢ়করণের সংগ্রামের এই মহানায়ক তাঁর কর্মনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধ এবং সমাজ ও জাতির প্রতি অভাবনীয় প্রতিজ্ঞার জন্যই আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। ভবিষ্যতে বিচার বিভাগের ভিত্তি যতই শক্তিশালী হবে ততই মাহমুদুল ইসলামের অবদান আমাদের স্মরণ করতে হবে।  

cross-circle