রিজওয়ান-আখ্যান ভূরাজনীতি ও শিল্পের সতর্ক আদনপ্রদান
অক্টোবর ১০, ২০২১

বলাবাহুল্য, ভারতীয় মানচিত্রের সবচেয়ে রক্তাক্ত অংশের নাম কাশ্মীর। ১৯৪৭ থেকে আজ অবধি প্রায় একইরকম আশাহীনভাবে বয়ে চলা শোণিতপ্রবাহ। “রিজওয়ান” কি সেই শোণিতপ্রবাহের গল্প বলছে? নাকি আশাহীনতার? মতাদর্শ-উত্তর যেখানে দুনিয়া, রাষ্ট্র যেখানে নিপীড়নের হাতিয়ার? রিজওয়ান কি কাশ্মীরের অশান্ত আত্মা? নাকি মৃত ভবিষ্যত? কিসের প্রতীক হয়ে উঠতে চায় রিজওয়ান? 

আগা শহীদ আলীর কবিতা, দীপ্তি খোরানার বানানো ছোট‣দর্ঘের সিনেমা ও বাংলাদেশের নাট্যনির্দেশক ক্সসয়দ জামিল আহমেদ নির্দেশিত মঞ্চনাটক থেকে এই প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করবো। ভারতের মূলধারার চলচ্চিত্রে পরিবেশিত “কাশ্মীর” থেকে রিজওয়ান-আখ্যানের “কাশ্মীর” অনেকখানি পথ। সেই পথ যখন বাংলাদেশের কোনো নাট্যনির্দেশক পাড়ি দিতে চান, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমরা এর ভেতরে নানাবিধ প্রতীকী ব্যঞ্জনা লক্ষ করবার লোভে উবু হয়ে বসি। বাংলাদেশে “রিজওয়ান” শুধুই কি কাশ্মীর-এর গল্প? নাকি আরো নানাবিধ কাশ্মীর নিহিত (বা নিহত) হয়ে আছে সেই গল্পের পরতে পরতে? কতটুকু ছোঁয়া গেছে ঘরের কাশ্মীরকে, দূরের কাশ্মীর দিয়ে? 

আদতে যা একটি কবিতা ছিল, তাকে একটি নাটকের (এবং চলচ্চিত্রের) ন্যারেটিভে পরিবেশন করবার প্রক্রিয়ায় যতটুকু ক্সশল্পিক রসায়ন ঘটলো, ভূরাজনীতির নিবিড় পাঠের সাথে সাথে তাকেও নিগূঢ়ভাবে খেয়াল করবার আগ্রহ আছে আমার। ফলে আলাপটি কেবলি নাটকের না, কেবল রাজনীতির তো নয়ই, বরং এসবের সমবায়ে নিজেদের ভাবনারাজিকে একটু উসকে দেয়ার প্রয়াস। আরো যেসব প্রণোদনায় এরকম একটি আখ্যান ভিন্ন ভিন্ন শিল্পমাধ্যমে এবং ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্রে পরিবেশিত হয়ে চলেছে, তার সাথে কাশ্মীর তথা নিপীড়িত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর আর্তনাদ, মৃত্যু এবং আরো নানাবিধ অভাবনীয় ভবিতব্য নিয়ে কথাবার্তা বলবার দায় রয়েছে আমাদের।   পত্রিকা, টেলিভিশন কিংবা ফেসবুকের হোমপেজে গেলেই নির্যাতিত, রক্তাক্ত, নিহত ও দেশান্তরী রোহিঙ্গাদের ছবি। বাস্তুভিটা জ্বলছে আগুনে আর লাখ লাখ পাড়ি দিচ্ছে সীমান্ত হেঁটে, নে․কায়, কাঁধে চড়ে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ। এক জাত্যভিমানী রাষ্ট্রের নিপীড়নে পৃথিবীর সবচেয়ে অভাগা রাষ্ট্রহারা গরিব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। একই সময়ে ঢাকায় এল রিজওয়ান। সে এসেছে কাশ্মীর থেকে। সেই কাশ্মীর, যেখানে শুধু ১৯৪৭ সালেই আড়াই লাখের বেশি মানুষ খুন হয়েছিল। ভিটাছাড়া হয়েছিল পাঁচ লাখের মতো। সেটা কেবল শুরু। সেই সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার রিজওয়ানকে হতে হয়নি। সে মরেছে আরো পরে। আগা শাহীদের কবিতাকে প্রামাণ্য করলে ১৯৯০ সালের দিকে। ’৪৭ থেকে ’৯০, ’৯০ থেকে আজতক কাশ্মীরে আগুন জ্বলছেই। ফলে রিজওয়ানকে আমরা স্বাগত জানাই। এই রিজওয়ান বড় চেনা আমাদের। 

এই কাশ্মীর থেকে আরাকানরকে কেন্দ্রে রেখে রাষ্ট্রীয় প্রযত্নে এই যে সংখ্যালঘু মুসলিম হত্যাযজ্ঞ, তাকে গভীরভাবে ভাবার দরকার আছে। ক্সসয়দ জামিল আহমেদ সেই সময়োচিত ভাবনার কৃতিত্বটুকু পাবেন। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি আগা শাহীদ আলীর কবিতার বই The country without a post office থেকে রিজওয়ানকে খুঁজে বের করেছিলেন ভারতের মেধাবী তরুণ নাট্যকার ও নির্দেশক অভিষেক মজুমদার। রিজওয়ান তার বহুনন্দিত কাশ্মীর ট্রিলজির প্রথম নাটক। জামিল আহমেদ নির্দেশিত রিজওয়ান মূলত অভিষেকের নাটকেরই বাংলা অনুবাদের মঞ্চায়ন। যদিও প্রচার-প্রচারণায়, বিশেষত পোস্টার-ব্রশিউরে ক্সসয়দ জামিল আহমেদের নামের ছায়ায় অভিষেক মজুমদার চাপা পড়েই থেকেছেন। এটা অদরকারি ছিল। দৃষ্টিকটু তো বটেই। কেননা অভিষেক রচিত নাটক রিজওয়ানকে জামিলের হাতে বেমানান লাগার কথা নয়। জামিল নির্দেশিত নাটক চাকা ও জামিল অভিযোজিত নাটক বিষাদসিন্ধু মিলিয়ে এ নাট্যনির্দেশকের যে ভ্রমণ, রিজওয়ান তার অনিবার্য গন্তব্য বলেই মনে হয়। রিজওয়ান কাশ্মীরের চিরচেনা গল্প। গণহত্যার গল্প জীবিত মানুষ বলতে পারে না। মৃত মানুষকেই বলতে হয়। ফলে রিজওয়ান মৃত। যেমন মৃত তার বাবা, দাদু, মা ও বোন ফাতিমা। তবে তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মৃত। ১৮ বছরের রিজওয়ান তখনো জীবিত, যখন তার পুরো পরিবারকে খুন করা হয়। কিন্তু মৃত্যুর উপত্যকায় তো মৃত মানুষের আলাদা বসতি থাকবে না, জীবিত মানুষেরই সঙ্গে মিলেমিশে থাকবে তারা! ফলে রিজওয়ান তাদের সঙ্গেই থাকে, এমনকি তাদের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে। তারপর একদিন সেও নিহত হয়, কাফেলা দীর্ঘ হয়। কিন্তু ততদিনে মৃত মানুষের মধ্যেও জীবিত মানুষের ভান আর মমতা ঢুকে গেছে। তাই রিজওয়ান মাঝিকে জানায়, সে যে মরে গেছে, এটা যেন তার মৃত আত্মীয়স্বজনকে না জানানো হয়। এভাবে এ মৃত মানুষের জবানিতে অভিষেক এক আশ্চর্য গল্প জড়ো করেন আমাদের শোনার জন্য। সেই গল্প, তার যাবতীয় মমতা ও বেদনাসমেত ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল নস্টালজিয়া-আক্রান্ত এক কাশ্মীরি প্রবাসী কবির কবিতায়। ফলে রিজওয়ান প্রায় গল্পহীন এক গল্প। তাহলে কবির হৃদয়ই নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রের জন্য এখনো বড় হুমকি? এ রকম একটি নাটককে বাংলা ভাষায় ও ঢাকার মঞ্চে পরিবেশন করার জন্য ক্সসয়দ জামিল আহমেদকে ধন্যবাদ জানাই। এখানে অল্প কথায় কয়েকটি পর্যবেক্ষণ হাজির করা যায়: 

অনুবাদের দোষে বাংলা ভাষায় রিজওয়ানকে অনেক ম্যাড়মেড়ে লেগেছে। কিন্তু জামিল আহমেদের ক্যারিশম্যাটিক পরিচালনা নজর কাড়বার মতো। মঞ্চটিকে তিনি অনেক সৃজনশীল উপায়ে ব্যবহার করেছেন। একটা ত্রিমাত্রিক আবহ ক্সতরি হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে। একটা নাটকের টানা ১০ দিনেরও বেশি ধরে প্রদর্শনী চলাও ঢাকার মঞ্চে বিরল ঘটনা। সেটার জন্যও তাকে কৃতিত্ব দিতে হয়। আমি নাটকের লোক নই, ফলে বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করার সুযোগ নেই আমার। কিন্তু এ নাটকে প্রচুর শারীরিক কসরতের ব্যাপার আছে। সেটা তার কলাকুশলীরা যেভাবে করেছেন, তাতে তাদের অনেক সময়ই ক্লান্ত মনে হয়েছে। এই ক্লান্তি ছোঁয়াচে, তা দর্শককেও আক্রান্ত করে থাকবে। যে কারণে রিজওয়ানের কলাকুশলীরা মঞ্চে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত করেন, সেই পরিমাণ আবেগ দিয়ে তারা উপার্জন করতে পেরেছেন বলে মনে হয়নি। অবশ্য ইমোশনাল এনগেজমেন্ট বলতে যা বোঝায়, রিজওয়ানের ফ্রেমের কারণেই সেটা হয়ে ওঠা দুরূহ। তার ওপর রয়েছে অনুবাদের সমস্যা। ওপরের এ বিষয়গুলোর সঙ্গে আরো বেশকিছু বিষয় আলোচনার দাবি রাখে। (সংক্ষেপিত। প্রবন্ধটির পুরো অংশ প্রকাশ হবে ২২ সেপ্টেম্বর বণিক বার্তার সিল্ক রুটে)

cross-circle